চড়ুইভাতি

sparrow
একটা ঝুড়ি, ঝুড়ির মাথায় বাঁধা একটা লম্বা সুতো। ঝুড়িটা উপুড় করা একটা ইটের সামনে। সুতো আর ইটের অবলম্বনে আধ খোলা। লম্বা সুতোটা চলে গেছে ছাতের চিলেকোঠার জানলা বরাবর। জানলায় একটি বালক। অপেক্ষায়, কখন ঝুড়ির নিচে রাখা গমের দানাগুলো খেতে দু চারটে চড়াই চলে আসে। ছাতের রেলিঙে চড়াই দুটো লাফ দিয়ে দিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। উড়ে আসে ছাতের উপর। নেচে নেচে কিচির মিচির করতে করতে ঝুড়ির নিচে আসতেই জানলায় বসে থাকা বালকটি সুতো কেটে দিল। চড়াই দুটো ধরা পড়ল। ছেলেটা নেমে এল চিলেকোঠার ঘর থেকে। ঝুড়ির ফুটো গুলো দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিল চড়াইগুলোকে। তারপর ঝুড়ি তুলে দিতেই পাখি দুটো উড়ে গেল ফুড়ুত করে, আকাশে। ছেলেটা চোখে হাত রেখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল চড়াইদের গমনপথে।

উপরের খেলাটা খেলতে ভাল লাগত। খেলাটা বন্ধ হল সেদিন, যেদিন সুতো কেটে দিতেই ঝুড়ি বন্ধ হল চড়াইয়ের ডানার উপর। চড়াইটাকে জল দিতে কিছুক্ষন ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। শুকতারায় পড়েছিলাম “চড়াই পাখীরা কোথায় যায়”। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম। সত্যি তো, চড়াই পাখী মারা যেতে দেখা যায় না তো! দুর্ঘটনার শিকার না হলে চড়াইকে মরতে দেখেছে কে? সাহিত্যিকের কল্পনায় চড়াই পাখী যখন অসুস্থ হয়, তখন সে চলে যায় একটা পাহাড়ের মাথায়। অপেক্ষা করে কখন মৃত্যু তাকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু বড় হয়ে বুঝলাম চড়াই অত উপরে ওড়ে না, সমতলেই তার আনন্দ, মানুষই তার প্রিয়। বলছি হাউস স্প্যারোর কথা। চড়াইয়ের আছে অনেক রকমভেদ। সে দিয়ে কাজ নেই, চড়াই আমাদের অনেকের জীবনেই নিত্য সঙ্গী ছিল।

চড়াই মানুষ ছাড়া থাকবেই বা কি করে! তার চাই শস্য খুঁটে খাওয়া, শস্যের ভাঁড়ারের কাছেই তার বাস। আর প্রিয় খাবার ঘাস পোকা। তখন ছিল বড় বড় বাড়ি, বাড়িতে ছিল ঘুলঘুলি। আমাদের বাড়ির ঘুলঘুলিতে ছিল জাফরি লাগানো। ঘাস বিচুলি, কাঠ কুটো দিয়ে চড়াইগুলো বন্ধ করে দিত ঘুলঘুলি, আর তাতেই সংসার পেতে বসত। একদিন ঝুল ঝাড়তে গিয়ে পাখির বাসা মাটিতে পরে তিনটে ডিম ভেঙে যাওয়ায় কি আফসোশ! চড়াই নাকি জাতে বাউন্ডুলে।সঙ্গী বা সঙ্গিনী জুটলে ভাল, না জুটলে কুছ পরোয়া নেহি। জীবন সঙ্গিনী জুটলে নানা বায়নাক্কা, ঘর বানাও, ডিম পারো, বাচ্চা মানুষ…..না না, চড়াই করো। তাকে ঠোঁটে করে খাবার এনে খাওয়াও। অনেকে এসব ঝামেলায় না থেকে নিম কিম্বা অশথ গাছে থেকেই জীবন কাটায়। চড়াই কিছুটা জীবন নিয়ে যেন উদাসীন, সারাদিন নাচে নেচে খুঁটে খুঁটে খাওয়াতেই তার দিব্যি চলে যায়। বৎসরান্তে যে পিকনিক করে মানুষ, তার বাংলা নাম চড়ুইভাতি, মানে জলে জঙ্গলের ধারে একটা দিন চড়ুইয়ের মত ভাত খুঁটে খাওয়া?

চড়াইয়ের নিন্দায় পঞ্চমুখ হলেন কবি যতীন্দ্র মোহন, বাবুই এর সাথে তুলনা করে ফেললেন।

বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
“কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টির, ঝড়ে৷”
বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়৷
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা৷”

ব্যস, রাতের ঘুম গেল, বাবুইয়ের বাসা দেখতে হবে। বাড়ির কাজের লোক নিয়ে এল বাবুইয়ের বাসা, কোথা থেকে কে জানে? কি সুন্দর! কি শিল্প!কবি তো এ দেখেই লিখে ফেলেছিলেন ওই সুন্দর কবিতাটা, যেটা বুকের গভীরে বিঁধে গিয়েছিল আমূল।

চড়াইরা আর আসে না। গ্রাম দেশে আসে। বহুতল বাড়ি চড়াইয়ের নাগালের বাইরে। কংক্রিটে ঢাকা পরে গেছে ঘাস। শহুরে বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে না ছোট্ট বুকগুলো। আরও জমি হাতাও কৃষাণের, বানও বহুতল ইমারত, মেট্রো, রেসিং ট্র্যাক, বিনোদন পার্ক, যেখানে কলের পাখি গান গাইবে, ডানা ঝাপ্টাবে, কিন্তু গমের দানা খেতে কোনোদিন নেমে এসে আবাক করে দেবে না কোন শিশুকে। দুই হাত বাড়িয়ে “দাও ফিরে সে অরন্য” বলে কি লাভ? সে তো সাহিত্যেই মানান।

ছবি সৌজন্য – অন্তরজাল

এভাবেও বেঁচে থাকা যায়

সবে তখন চাকরিতে যোগ দিয়েছি। আশারাম নামে একজন নেপালী হেল্পার পেলাম ল্যাবে সহায়তার জন্য। আমারি মত সেও একজন সরকারী চাকুরে এবং স্থায়ী। গাট্টা গোট্টা বেঁটে চেহারা, চোখদুটোতে বেশ বুদ্ধি দীপ্তি। বয়স এই আমারি মত।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিজ্ঞেস করত হটাৎ করে, ” চায়ে লাউঁ সাব?”। আমার আবার বেজায় চায়ের নেশা। তাই সমবয়সী এই যুবকটি কয়েকদিনেই আমার বেশ কাছের লোক হয়ে উঠল। সহকর্মীরা সাবধান করে দিলেন, আশারামের আশার ছলনায় যেন না ভুলি। সে নাকি টাকা ধার করে ফেরত দেয় না। আর বেজায় ‘দারুর’ নেশা। পেটে খাবার না থাকলেও চলবে, চলবে না সুরার খোরাক না থাকলে। লক্ষ্য করলাম, সারাদিনই সে নেশায় থাকে। কিন্তু জাতে মাতাল হলেও কাজে ঠিক। কোন মেশিন কি কাজে আসে, কোন মেশিন বিগড়ালে শব্দের পরিবর্তন কেমন হয়, সে সব তার আঙ্গুলের ডগায়। কাজেই সে এক অপরিহার্য মানুষ। সে যে এমনিই ভাল ছেলে, কি আর যায় এসে ‘মাঝে মধ্যে’ নেশা টেশা করলে।

মাস ফুরোলে তখন ক্যাশে পে করা হত মাসমাইনে। ক্যাশিয়ার টাকা গুনছে গোমড়া মুখে, কাউন্টারের বাইরে আশারামকে ঘিরে কিছু মানুষের ভিড়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা। জানা গেল প্রতি মাসে আশারাম টাকা ধার নেয় এর ওর কাছে, মাসমাইনের দিনে উত্তমর্ণের দল কলার ধরে টাকা আদায় করে। সব বিলানোর পর ওর হাতে কিছুই থাকে না, আবার দু তারিখ থেকে ধার শুরু। এ ভাবেই চলতে থাকে তার জীবন। শুনলাম একবার মাইনের থেকে বেশি ধার করায় দু একজনের ধার বাকী থেকে যায়,  তারা অফিস ছুটির পর আশারামের জামাকাপড় কেড়ে নেয়। কাজেই অনেক রাতে সে শুধু ‘কাচ্ছা’ পড়েই বাড়ি ফেরে।

একদিন জিজ্ঞাসা করলাম এ ভাবে ওর চলে কি করে!  হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘চলতা হ্যায় সাব – এয়সেহি, আপলোগো কি সমঝ কি বাত নেহি হ্যায়’। শুধালাম ওর ‘বিবি, বাচ্চা’ আছে কি না। বলল, বউ ওর থেকে পাঁচ বছরের বড়, ছেলে মেয়ে চারটি – কেউ স্কুলে যায় না। বউ আবার ‘দারু’ না পেলেই ওকে বেজায় পেটায়। দেখলাম মুখে একটা সলজ্জ সরল হাসি ঝুলে।

দু দুটো মেশিন চলছে একসাথে। চারজন একসাথে গভীর মনোযোগে কাজ করছি। হটাৎ একটা মেশিনের আওয়াজ থেমে যেতে বিরক্ত হয়ে দেখি, আশারাম মেশিনের সুইচ অফ করে মেশিনের নীচে কিছু দেখছে। বলল, শব্দ শুনেই বুঝেছিল আর কিছুক্ষন মেশিন চললে গীয়ার বক্স ভাঙত। অঘটনের হাত থেকে সেদিন বেঁচেছিলাম তার দক্ষতার জন্য। পিঠটা আলতো চাপড়ে দিতেই হাত বাড়াল, ‘এক পচাস কা নোট দো না সাব!’ তখন সেই ‘পচাস’ অনেক টাকা। দিয়েই দিলাম। এবং ফেরত পাবার আশা ছেড়েই। চমকে দিল মাস পয়লায়। দেখি আশারাম দৌড়তে দৌড়তে আসছে। পিছনে দু জন আরও ছুটছে। ভাবলাম পাওনাদারেরা তাড়া করেছে বোধহয়। কাছে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে হাত বাড়িয়ে পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে বলল, ‘লো সাব, আপকা রুপেয়া’। পিছনে তাড়া করে আসা দুজন তখন থমকে দাঁড়িয়েছে। ওদের লোলুপ চোখ টাকাটাকে গিলছে। বললাম, সে হয় না আশারাম, ওদের টাকা আগে ফিরিয়ে দাও। সে দম নিতে নিতে বলল, ‘আপস কি বাত হ্যায় সাব, হাম কর লেঙ্গে হিসাব কিতাব বাদ মে…।।’  টাকাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, ফেরত পাবার আশাই যে করি নি! পঞ্চাশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমি বেবাক সেদিন – একা।

একদিন সকালে ল্যাবে কাজ করার জন্য আশারামকে ডেকেও পেলাম না। অনেক পরে মূর্তিমান এসে হাজির আমার কাছে, কিছুটা ঢিলে ঢালা অবস্থা। দেরী হবার জন্য একপ্রস্থ গালাগাল খাওয়ার পরও মুখে হাসি না দেখে অবাক হয়ে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায়, অশ্রুসজল চোখে বলল, তার ‘বিবি’ গতকাল রাতে পালিয়েছে তারই বড় ভাইয়ের সাথে। এই পরিস্থিতিতে কি ভাবে স্বান্তনা দিতে হয় তখন জানা ছিল না। শুধু পিঠটা চাপড়ে দিতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’কোই বাত নেহি সাব, আচ্ছা হ্যায়, জানে সে পহলে বাচ্চোকো লে কর গয়ী। কৌন করে দেখভাল!’। দু মাস পর শুনলাম আর একটা বিয়ে করেছে। দু চার দিন জামাকাপড়ের চকচকে ভাব কারো চোখ এড়াল না। মহিলা কর্মীরা মুখ টিপে হেসে নিলেন কদিন। দু চার দিন পর আবার পুনরাবস্থা। টাকা ধার, ময়লা জামাকাপড়, সব এলোমেলো।

বছর ঘুরতে না ঘুরতে শুনি নতুন বউও পালিয়েছে। এবার আশারামের শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। মদ্যপানের মাত্রাও বাড়ল। কাজ করতে করতে হাঁফাত। মাঝে মধ্যে পেট চেপে ধরত। প্রচণ্ড কাজ এল ল্যাবে। কাজের মধ্যে একদিন শুনি মেশিনেকে গালাগালি করছে। মনে হল হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বললাম বিশ্রাম নিতে। বলল, ‘কাম করণে কে লিয়ে সরকার তনখা দেতি হ্যায় সাব, ম্যয় ঠিক হু’। কাজ শেষ হলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল আমার কাছে এ যাবত কত টাকা ধার নিয়েছে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, ‘কিতনা বাতা দিজিয়ে, ম্যায় ওয়াপস করনা চাহতা হু’। লিখে রাখিনা তাই বলতেও পারলাম না। পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝে খুঁড়তে খুঁড়তে বলল ,’এক বিশ কা নোট দো, পুরানা হিসাব কা সাথ জোড় লেনা’।

এক শীতের সকালে অফিসে ঢুকতেই সহকর্মী খবর দিল আশারাম গুরুতর অসুস্থ। একা থাকত। প্রতিবেশী হাসপাতালে দিয়েছে। কিছু লোককে পাঠান হল হাসপাতালে। আশারামকে পাওয়া গেল না। প্রথম বউ মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোথা থেকে আশারামের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেবার অভিপ্রায়ে ফিরে এসেছে। ভাবলাম কি বিচিত্র মানুষের মন। ‘একি অপূর্ব প্রেম দিল বিধাতা!’ ঘর জ্বালানী পর ভুলানির মন প্রেমের বাতাসে ভেসে উজান পাড়ি দেয়। নিন্দুকে বলল দ্বিতীয় বউয়ের সাথে আশারামের নাকি বিয়েই হয় নি।গরীবের লিভ ইন, ভেবে নিজেই মনে মনে খানিক না হেসে পারলাম না। “ম্যারেজ ইস এন ইন্সটিটিউসন” – ব্যর্থ হয়ে ভেঙ্গে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে।

তিনদিন পর অফিসে আশারামের প্রথমা এল আমার কাছে। ক্ষয়াটে চেহারার মধ্যবয়সী রমণী, ধূর্ত চোখে লোভ চিক চিক করছে। আসবার উদ্দেশ্য সরাসরি জানিয়ে দিল। স্বামী মরলে কত টাকা পাওয়া যাবে।বিরক্ত হয়ে  বললাম, আমার কাছে কেন, একাউন্টস ডিপারমেন্টে যাও। জানা গেল আশারাম আমার কাছে খোঁজ নিতে বলেছে। তদ্বির করার লোকের আভাব হল না।অসুস্থ স্বামীকে দিয়ে কাগজে সই করিয়ে পি এফ থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেল, ‘ইলাজের’ আছিলায়। যাকে পতি প্রেম বুঝেছিলাম, তা মিথ্যে প্রমান হয়ে নিজের কাছে যেন হেরে গেলাম।

কদিন পর ‘দাওয়া’ না পেলেও ‘দারুর” প্রভাবে আশারাম তার ‘উধারী দুনিয়া’ থেকে মুক্তি পেয়ে গেল। শ্মশানে মৃতের বুকের উপর কাঠ চাপানো হল একটার পর একটা। যেন ঋণের বোঝা । ইচ্ছা হল সরিয়ে দিই। বড় কমজোর ছিল ওর বুক। পুড়তে থাকা শরীরের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে উঠল। বুকে হাত দিতে পকেটের দশ বিশ পঞ্চাশের নোটগুলো খর খর শব্দ করে উঠল।

মনে হল পিছন থেকে কে যেন মৃদু স্বরে বলল,’এক পচাস কা নোট দোগে সাব? আগলা তনখা মে লে লেনা…।’

আমি যে রিসকাওয়ালা……।

images[1]

তখন আমি দশম শ্রেনী, আমি তখন ষোল –

বাবার সাথে বেড়াতে গেছি বেনারস। তীর্থে নয়, আমার বাবা যেহেতু রেলের পাশ পেতেন, তাই বৎসরান্তে আমারা মাঝে মধ্যে বেড়িয়ে পরতাম এখানে সেখানে। বেনারসের ধর্মশালা থেকে বেরতেই ঘোরাঘুরির জন্য নিতে হল রিক্সা।

বাবা নিখুত বাংলাতেই রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই রিক্সা যাবে?”
খাঁটি বাংলাতে জবাব এল, “যাব বাবু, আসন গ্রহণ করুন”।
রিক্সায় উঠব কি, ভাষা শুনে থমকে দাঁড়িয়েছি। এ ব্যাটা বলে কী! এত বিশুদ্ধ ভাষা, তার উপর আবার রিক্সা চালায়!

আমদের চক্ষু চড়গ গাছের মগডালে দেখে একটু হেসে বলে, “কালক্ষেপ করবেন না বাবু, বেলা দ্বি প্রহর হল। সব পরিক্রমা করতে হবে তো।”
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন,” তা কত দিতে হবে তোমাকে, ইয়ে আপনাকে?”
-“আমি রিক্সা চালাই বাবু। ওই তুমিতেই অধিষ্ঠাণ করুন”।
-“কত দিতে হবে তো বল!”
-“আপনি বিবেচক, খুশী হয়ে দিয়ে দেবেন যা হোক…”
-বি এইচ এউ তে নিয়ে চল আগে” বাবা বলে।
-“বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বলছেন বাবু?”
-“বি এইচ ইউ ত হল।
-“না, আমরা ত হাওড়া জেলার লোক, তাই শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত।”
-“সে তো দেখতেই পাচ্ছি”।

বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, “বাড়ি কোথায়?”
-“আজ্ঞে!”
-“বলছি কোথায় নিবাস?”
-“হাওড়া জেলায় বাবু…”
-“হাওড়ায় কোথায়?”
-“বাগনান”
-“ও বাবা, সেখানে আমার এক শালী থাকে যে!”
–“শ্যালিকা? কোন জায়গায়?”
-“সে তো ভুলে গেছি বাপু। তার বিয়ের সময় গেছি, সে কত বছর আগে মনেও পরে না। বেজায় মশা সেখানে…”
– “রেতে মশা দিনে মাছি,
এই তাড়্‌য়ে কল্‌কেতায় আছি।”
-“বল বাগনানে আছি”
-“ওই হল যা হোক”

কখনো ডান দিক কখনো বাম দিকে শরীর বাঁকিয়ে এই পা, ওই পায়ের ভরে প্যাডেলে চাপে রিক্সা চলে অলি গলি দিয়ে। হঠাত মোড়ের মাথায় বাঁক নিতেই বাবা আঁতকে উঠলো, “একি তোমাকে যে বি এইচ ইউ তে আগে নিতে বললাম…..”।
-“আরে বাবা বিশ্বনাথের মন্দির দেখে যাবেন না আগে? ওটাই আগে পড়বে…”
-“তোমাকে যেদিক দিয়ে যেতে বলছি সেদিক নাও, কাশীর রাস্তা আমাকে চিনিও না”
রিক্সা চালকের মুখ ভার। সে হয়ত বিশ্বনাথের মন্দিরে আগে নিয়ে গিয়ে দুটো পয়সা পেতে চেয়েছিল।
ব্যজার মুখে রিক্সার মুখ ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, “বাবু কি রাগান্বিত হলেন?”
বাবার অবস্থা হাসে না কাঁদে। বলে, “লেখাপড়া কদ্দুর করেছ হে?”
-“কলেজে নাম লিখিয়েছিলাম ম্যাট্রিকের পর। পড়াশুনোতে খারাপ ছিলাম না। দরিদ্রের আবার বিদ্যার্জন”।
-“বিয়ে করেছ?”
– “আজ্ঞে হ্যাঁ”
-“বউ বাচ্চা এখানে থাকে?”
-“না বাবু। সাথে রাখলে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রী”

মনে হল বাংলার মাস্টারমশাইয়ের সাথে চলেছি রিক্সা চেপে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বনাথ মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট, মনিকরণ ইত্যাদি ঘুরে ফিরে এলাম। সমস্যা হল রিক্সার ভাড়া দেবার সময়। বকসিসে খুশী করা গেল না বঙ্গ পুঙ্গবকে। বেঁকে বসল। অনেক টানাপোড়নের পর নিমরাজি হয়ে রিক্সায় চড়ে বসে প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলে গেল, “বাবু কি রাগান্বিত হলেন?”

ইলিশের বাঙালী

ইলিশের আমি ইলিশের তুমি, ইলিশ দিয়ে যায় চেনা। কাকে আবার, আমাদের বাঙালীদের! ইলিশ না খেলে হবে না বাঙালী। বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে , রক্তে রক্তে ইলিশ।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন-

‘ইলশে গুঁড়ি!   ইলশে গুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম|

ইলশে গুঁড়ি  ইলশে গুঁড়ি দিনের বেলায় হিম|’

বর্ষা এল তাই কবিও দেখছেন ইলিশ মাছের নাচ- ‘হালকা হাওয়ায়  মেঘের ছাওয়ায় ইলশে গুঁড়ির নাচ’।নাচ বলে নাচ, মাছে ভাতে বাঙালী নাচে ইলিশের গন্ধে।

আহা, কোথায় সে দু কিলো ওজনের এক একটা ইলিশ। তেলে হাত পিছলে যাওয়া, একদিন খেলে দু দিন হাতে বয়ে বেড়াতে হত সে সুগন্ধ। দু কিলোর মাছ কাটছে মাছমারা, আঁশ ছাড়িয়ে মুড়ো আর ল্যাজা কেটে লম্বা লম্বি দিল চিড়ে। তারপর দুটো সানকিতে মাছ দু ভাগে রাখছে, পেটি আর গাদা। দুজন ক্রেতা নিবিষ্ট হয়ে মাছকাটা দেখছে, ভাগে কম পড়ল না তো!বাড়ি ফিরে মাছের থলে হাতে নিয়ে গিন্নির প্রফুল্ল বদন, পেটি দিয়ে ভাপে আর গাদাগুলো পাতুরি। সে সব খেয়ে কেয়া বাত কেয়া বাত।

এ জন্যই বোধহয় বুদ্ধ কবি লিখেছিলেন-

‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে

জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,

নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।

তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ;

কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁজে।

এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব’

ছোট বেলায় স্কুল যেতে একটুও ভাল লাগত না।সকাল বেলায় একদিন ঘুম ভেঙে দেখি কলতলায় বিশাল এক ইলিশ নিয়ে বসে আমার মা। সেই গাদা পেটি আলাদা হচ্ছে। আমার সোজাসুজি ফরমান- স্কুল যাব না। বাবা মৃদু হেসে আমাকেই সমর্থন করাতে ‘কি আনন্দ কি আনন্দ!’ ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলায় আমরা বাড়ির সবাই একদিকে আর আমার বাবা আর একদিকে, আমরা ইস্টবেঙ্গল আর বাবা মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গল জিতল, বাবা বাজারে গিয়ে ব্যাজার মুখে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরল, হাতে দুটো ইলিশ।  আমরা হই হই করে উঠলাম। প্রিয় টিম হেরে গেলেও আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে বাবার মুখেও হাসি। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এলেন বাবার বন্ধু ।উঠেছিলেন ক্যম্পে। কয়েক দশক পর আমাদের বাড়ি ঠিকানা খুঁজে, পুরোন বন্ধুর সাথে দেখা। হাতে ঝুলিয়ে আনলেন একটা মুখে দড়ি বাঁধা রুপোলী ইলিশ আর একটা আস্ত কাঁঠাল।  ঘরছাড়া দিশাহীন মানুষ, তবু বন্ধুর জন্য উপহার। দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আপ্লুত। মায়ের হাত ধরে ইলিশের প্রস্থান রান্নাঘরে।

রবি কবি ইলিশ ভাল বাসতেন না নিশ্চয়। না হলে তার লেখায় ইলিশ অনুপস্থিত কেন? ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’ তে কিন্তু আছে ইলিশ মাছের রেসিপি। নজরুলও লেখেন নি ইলিশের কথা। এঁরা কি বাঙালী ছিলেন না? না, কথা হচ্ছে আমাদের মত আটপৌরে বাঙালীদের নিয়ে। একজন উচ্চপদস্থ বাঙালী কে একবার আফসোস করতে শুনেছিলাম, ‘ইস কতদিন ইলিশ খাই না! যা দাম!’ না, দামের কথাটা আছিলা। পরে শুনেছি ওনার গিন্নি ইলিশের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না।

এখন যে ইলিশ পাওয়া যায় সেটাকে একসময় বলা হত – খোকা ইলিশ। খুকি ইলিশ নয় কেন কে জানে! খোকা হোক বা খুকু হোক, ডিম না হলে আবার ইলিশ কি! (পুরুষ ইলিশও কি ডিম ছাড়া মেয়ে ইলিশ পছন্দ করে?) সাড়ে চারশো গ্রাম ওজনের ইলিশে ডিম কোথায়? নোনা জল থেকে মিষ্টি জলে এলে মাছ গায়ে গতরে বড় হয়, ডিম দেয়, ডিম ছাড়ে, ছানাপোনা হয়, উলটো স্রোত পাড়ি দিতে ধরা পরে, তারপর না তার স্বাদ! একে নিয়ে বাঙালীর যত গল্প যত মান – আভিমান – আবেগ।

একহাজার ইলিশের পদ নিয়ে বই লিখেছেন লন্ডনের বিখ্যাত এক সেফ, বাসস্থান বাংলাদেশ। তার ভূমিকা লিখেছেন হুমায়ুন আহমেদ সাহেব। পদ্মা নদীর মাঝি সিনেমায় হত দরিদ্র নায়ক পান্তা ভাত খাচ্ছে ইলিশ ভাজা দিয়ে, সারাদিনের নামে খাওয়া যে! এখন সেই দুকিলো ওজনের মাছগুলো দিয়ে ইফতার পার্টি করছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। খোকা খুকু ইলিশ কিনতে কিনতে মাসের শেষে আমাদের জীবন নিয়ে টানাটানি।

রতনে রতন চেনে……।

রতন টাটা বলেছেন – ‘ জীবনটাকে অত সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন নেই, জীবন আজ আছে কাল নেই।’ কথাটা দৈনিক নিত্যানন্দে ছাপা হয়েছে। আজ তুমুল একচোট আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে বাজারের মোড়ে চায়ের দোকানে। আমাদের পাড়ার রতনদা, যে নাকি ফায়ার ব্রিগেডে কাজ করে, যার ভাইয়ের একটা আটা পেষার দোকান আছে, সে কথাটা শুনল সাত সকালে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে। কথাটা মাথায় ঢুকে একেবারে গেথে বসে গেল। রতন দা এরপর তিন মাথার মোড়ের সার্বজনীন কলতলায় গেল দাঁত মাজতে। কল পাড়ে দাঁড়িয়ে পাড়ার মেয়ে বউ। রতন দা একমনে রতন টাটার কথাগুলো গভীর ভাবে ভাবতে ভাবতে একমনে দাঁত মাজতে মাজতে জল ভরা দেখছে। জল ভরছে একটি সদ্য স্কুল ছাড়া মেয়ে।রতন দার দৃষ্টি একেবারেই তাকে অনুসরণ করছিল না।কিন্তু মেয়েটির মা অন্য কিছু ভেবে রতন দার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে খড়গহস্ত হলেন। ব্যাস শুরু হল এক দক্ষযজ্ঞ। রতন দার ধ্যান যখন ভাঙল, ততক্ষণে রতন দার বউ সিনে। তিনিও কম যান না। চোখা চোখা বানে সব্বাইকে বিদ্ধ করে রতন দা কে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরে।

রতন টাটা বলেছেন ‘ জীবন এই আছে এই নেই, জীবন থেকে বেশি আশা করা নিরর্থক’। রতন দা তাই দু মুঠো পেটে ঠুসে, গণ পিটুনি খাওয়া সারমেয় সদৃশ মুখে, রওনা দিল আপিসে। গিয়েই শুনল কোথায় যেন আগুন লেগেছে। বেরতে হল টাং টাং বাজিয়ে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির মাথায় ত্রিশঙ্কু হয়ে। বাজারে আগুন। লাফ দিয়ে সবাই নামলেও, রতন দা নট নড়ন চড়ন। মাথায় ঘুরছে রতন টাটা বলেছেন – ‘ জীবনটাকে অত সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন নেই, জীবন আজ আছে কাল নেই।’ সবার ডাকাডাকিতে সাড়া না দেওয়ায় ফল হল ফিরে এসে কাজে গাফিলতির জন্য শো কশ নোটিস।

আমাদের পাড়ার মন্টু, যে ফুটবল মন্টু বলে পরিচিত, এক সময় সে ভাল ফুটবল খেলত বলে, সেও আজকের খবরটা চায়ের দোকানে শুনে আসার পর থেকে আর স্থির থাকতে পারছে না। রতন টাটা বলেছেন, ‘ বছরে ৫০ টা উইক এন্ড। আনন্দ কর।’     ইস সব নষ্ট, ভাবে মন্টু। আজ শনিবার, তাই পনের বছরের রেলের শান্ট ম্যানের কাজে যেতে হবে না। বাড়ি ফিরে মন্টু শুয়ে পড়ে। চোখটা লেগেছে কি লাগেনি, গিন্নির প্রবেশ। ‘বলি শুয়ে থাকলে কি চুলো জ্বলবে? বাজারে কে যাবে?’ মন্টু মটকা মেরে শুয়ে থাকে আর ঠিক করে আজ বাজারে যাবেই না। রতন টাটা বলেছেন, ‘জীবন উপভোগ কর’। মেয়ে এসে বলল, ‘ বাবা মা বলছিল বাজারে না গেলে রান্না হবে না। ‘ মন্টু কেতরে শুয়েই থাকল, ওঠার লক্ষণ নেই দেখে মেয়েও সরে পড়ল। বেলা বাড়তে মা মেয়েতে চলে গেল মন্টুর শ্বশুর বাড়ি।শুয়ে শুয়ে মন্টু স্বপ্ন দেখে একটা সে রেলের অফিসার হয়েছে…

বিষ্টু দা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কেরানি। মাথায় টাক, মধ্যস্থল স্ফীত। তিনটি মেয়ে, আর সাহস হয় নি। একটির বিয়ে দিয়েছেন্  বনহুগলীতে। আর দুটি সেলাই শেখে। অফিসে এসে এক গ্লাস জল খেতেই, ধপাস করে কাগজটা ফেলে দিল টেবিলে, অফিসের ফিচেল মিত্তির। ‘রতন টাটা কি বলেছে পড়েছেন?’ বিষ্টু দা সকালে খবরের কাগজ পড়ার আর সময় পান কখন! ঝোলা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে লালগোলা এক্সপ্রেস ধরতেছোটা, তারপর শিয়ালদায় নেমে দু মাইল হেঁটে বা ছুটে অফিস। দৈনিক নিত্যানন্দে খবরটা লিখেছে বেড়ে। বেশ রসিয়ে রসিয়ে। আহা, এতবড় সংস্থার কর্ণধার, কি ব্যক্তিত্ত, কি বাচন! বিষ্টু দার মন ছুঁয়ে গেল। আড় চোখে নতুন তরুণী  টাইপিস্টের দিকে তাকালেন। গলাটা শুকিয়ে গেল। এক ঢোঁক জল খেয়ে ভাবলেন, রতন টাটা বলেছেন, ‘প্রেমে পড়, দরকার পড়লে একটু বউয়ের সাথে একটু ঝগড়া…।’ ঝগড়া তো নিত্যসঙ্গী, প্রেমে পড়লে কেমন হয়? নিজের মুখটা টেবিলের কাঁচে একটু দেখে নিলেন। নাঃ,  টাকটা একটু বেশিই প্রশস্ত মনে্ হল, প্রেমে পড়ার জন্য অন্ততঃ।ভাবতে লাগলেন রতন টাটা বলেছেন – ‘ জীবনটাকে অত সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন নেই, জীবন আজ আছে কাল নেই।’ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন নিজেই জানেন না। পিওন এসে ডাকায় সম্বিত ফিরল, ‘বিষ্টু দা , স্যার ডেকেছেন চেম্বারে’। বিষ্টু দা ঘামতে ঘামতে চেম্বারে যেতেই সাহেবের ধমক, ‘এটা কি ঘুমোবার জায়গা? আর কদিন বাকি আছে রিটায়রমেন্টের? ছুটি দিয়ে দিচ্ছি একেবারে, বাড়ি গিয়ে রোজ ঘুমাতে পারবেন। যত্ত সব। আজকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যান।’

এঁরা কেউই জানতেন না, রতন টাটা অকৃতদার।

পাগলে কি না বলে !

এতদিন জানতাম পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়। ভেবে দেখলাম, একেবারে ভুল। ছাগল অনেক  কিছুই খায় না, যেমন আমি কোনদিন ছাগলকে মাংস খেতে দেখি নি, ছাগলের মাংস তো আমরাই খাই। ছাগলকে পিজা বা বার্গার খেতে কেউ দেখেনি বলেই তো মনে হয়। পাগলও তেমনি যা খুশী  কখনো বলে না। একটু কান দিয়ে আর মন দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে, পাগলের ভিতর বাস করে এক একজন দার্শনিক। পাগল মন সাগরে ডুব দিয়ে হয় সমাহিত। তাই তাকে বুঝতে হলে চাই মন।ভাল করে ভাবলে দেখা যায়, পাগলরাই সংসারের চালিকা শক্তি।

পাগল কয় প্রকার ও কি কি? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম।বুঝলাম পাগলের প্রকার হয় না, আকারেই তার প্রকাশ। পাগলের শিক্ষিত আশিক্ষিত প্রকার ভেদও করা যাবে না, কারণ সব পাগলেরাই শিক্ষিত। সবার আছে নিজস্ব স্পেসালাইজেসন, আলাদা আলাদা। পাগলের তাই জাত নেই, কুলও নেই।

মেয়েরা কেন যে পাগলে ভয় পায় কে জানে! আসলে বোধহয় তারা জানে একজন পাগল, না যায় দশটা পাঁচটার অফিসে, না যায় শপিং মলে আর বকা খেলে বেজায় ক্ষেপে যায়। আমার এক বান্ধবী, আমার কলেজ জীবনে, পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার  আমার গায়ে উঠে পড়েছে পাগল দেখে। সেই থেকেই বোধ হয় আজও শেষ হল না আমার খাঁটি পাগলের সন্ধান।

“মনের মতো পাগল পেলাম না, আমি তাইতে পাগল হলাম না”

আমার কলেজ বেলায় এক কাকু আসতেন আমাদের বাড়িতে, জনার্দন কাকু। হাতে আনতেন চার – পাঁচটি বই। বসে বসে পড়তেন। তখন কথা বলতেন না। নিজের বাড়িতে বসে পড়ার কি আসুবিধা ছিল তা আর জিজ্ঞেস করে হয়ে ওঠা হয় নি। বইতে মুখ ডুবিয়েই হটাত একসময় বলে উঠতেন- ঘড়িতে কি দশটা বাজে, দ্যাখ তো। যেখানে বসতেন সে খানে কোন ঘড়ি ছিল না। অন্য ঘরে গিয়ে ঘড়িতে দেখতাম কাঁটায় কাঁটায় দশটা। অথচ জনার্দন কাকুর হাতে বাঁধা থাকত না কোন রিস্টওয়াচ। এরকম প্রায়শ হতে দেখে একদিন বললাম- কাকু তোমার কি বায়োলজিকাল ক্লক আছে? হাসলেন, কিছু বললেন না।

একদিন জনার্দন কাকু সকাল দশটায় এলেন। মুখে হাত চাপা, কোন কথা নেই। একঘণ্টা বসে থেকে উঠে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলাম- কি হল কাকু, চললে না কি? কোন কথা নেই। দু দিন পর এসে বললেন-সেদিন কি হয়েছিল জানিস? কিছুই জানিনা, তাই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললেন- সেদিন দাঁত তুলে এসে ছিলাম সাইকেলের দোকান থেকে। আমি তো হতবাক। সাইকেলের দোকানে আমিও যাই, সে তো সাইকেল সারাতে। দাঁত ,সাইকেলের দোকান, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কাকু বললেন- একটা দাঁত নড়বড় করছিল। সাইকেলের দোকানের পচাকে বললাম- প্লাস দিয়ে হ্যাঁচকা টান দে। প্রথমে  ভয় পেলেও ত্বিতীয় হ্যাঁচকায় দাঁত পটাং করে উঠে এল।

“ফকিরি করবি খ্যাপা কার লাগি………”

সে তখন তরুণ তুর্কী। দাড়িওয়ালা মুখে ঝকঝকে চোখ দুটো চোখে পড়ার মতো। সে তখন দিল্লী এসেছে সিভিল সার্ভিস দিয়ে ট্রেনিঙে। একরাত আমার বাড়িতে। আমার গিন্নী তখন কোলকাতা গেছেন আমাদের প্রথম সন্তানকে টেবিলস্থ করতে। কাজেই তারুন্যে ভরপুর সেই মানুষটি একরাতে আমার কাছে। বেজায় আড্ডা চলছে। তার লেখা ছড়া শুনছি। সে আচমকা জিজ্ঞাসা করল- দাদা, বাংলায় আনুবাদ করতো- চুরাকে দিল মেরা গোরিয়া চলে। গানটি তখন বাজারে খুব হিট। আমি পারব না বলাতে আনুবাদ করল নিজেই- চুরি করে আমার মন, মেয়েটা পালায়। রবীন্দ্র কবির প্যারডি “বাঘের কলে মোষ উঠেছে ধরল তিপে টুঁটি…।।” অসাধারন লাগল। এই আনুবাদের ধাক্কায় রাত ভোর হয়ে এল। সে এখনো ছড়া লেখে বাচ্চাদের জন্য আর তাদের জন্য বাজায় ঢাক, পৃথিবীকে সাদা আর কালোয় দেখবেনা বলে রামধনু রাঙানো চশমা পরে। তার দাড়িতে যেমন লেগেছে সাদা ছোপ, লেখার হাত হয়েছে আরও পক্ক।

“এ দিল, এ পাগ্‌ল, দিল মেরা………”

একসময় গভর্নমেন্ট আফিসে একটা পোস্ট ছিল – যাদের বলা হত কমপিউটার। তারা ছিল মানুষ কমপিউটার, যন্ত্র মানব নয়। ডাটা কমপিউট করতে হত। এমনই একজন মানুষ ছিলেন আমাদের আফিসে, পবন মাত্রে। খুব ব্রাইট। একদিন দেখলাম পবন আমাদের আফিসের সামনের ভরা রাস্তায় ট্রাফিক সামলাচ্ছে, মানে দুই হাত ট্রাফিক পুলিসের কায়দায় নাড়িয়ে চলেছে আর তাকে ঘিরে প্রবল যানজট। কয়েকজন দৌড়ে গেল পবনকে টেনে আনতে, ট্রাফিক পুলিসও এল দৌড়ে। কিছুদিন পর ওকে ক্যান্টিনে দেখা হতে যেই বারণ করলাম ওভাবে বিপদের ঝুঁকি নিতে, সে বলল- রোজ ইতনা ট্রাফিক, কিসিকো তো লেনা পড়েগা না রেস্পন্সিবিলিটি! আর একদিন দেখা হতে জিজ্ঞেস করল – মার্স মে পানি মিলা ক্যা? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দেখে বলল- আপকো কুছ ভি পতা নেহি, ক্যায়সা সাইন্টিস্ট হ্যায় আপ! ব্যাজার হয়ে বললাম – মিলেগা তো বাতাউঙ্গা। এরপর তার ট্রান্সফার হল অন্য অফিসে।

“ক্ষ্যাপা খোঁজে ফেরে পরশপাথর”

সমরেশ বসু থাকতেন  নৈহাটি তে।ওখানেই কেটেছে আবার জীবনের প্রথম ভাগ। ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে থাকতেন। এটা জনার্দন কাকুর মুখে শোনা। উনি একটা গল্প লিখেছিলেন ভবা পাগলা কে নিয়ে। ভবার রাজত্ব ছিল মেয়েদের স্কুলের সামনের আধ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে। এক বাড়ির রোয়াকে শুয়ে থাকত সে।যে যা দিত, তাই খেত আর মাঝে মাঝে প্রানে ফুর্তি হলে হাত পা তুলে, দুলে দুলে, নাচত। গল্পটা খুব জনপ্রিয় হয়। সমরেশ বাবুর এক বন্ধু একদিন চুপিচুপি ভবাকে বলে দিল- ওই লোকটা তোকে নিয়ে বই লিখে আনেক টাকা পেয়েছে, ছাড়িস না। ব্যাস আর যায় কোথা, ভবা তক্কে তক্কে থেকে একদিন ধরল সমরেশ বাবুকে তার রাজত্বে। ভদ্রলোক বাজার যাচ্ছিলেন। ভবা প্রায় জড়িয়ে ধরে আর কি! – দে শালা টাকা দে। আমাকে নিয়ে বই লিখেছিস, বার কর শালা টাকা…।।। কি আর করেন, ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবীতে কাদা লাগার ভয়েই হোক, বা দয়া পরবশ হয়েই হোক, কিছু টাকা সেদিন ছাড়তেই হয়েছিল তাকে।

“ওরে মন পাগলে করল আমায় ঘরছাড়া……”

কাঁধে ছেঁড়া ঝোলা ব্যাগ, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, ময়লা ফুল প্যান্ট ফুল শার্ট, তিনি উঠে দাঁড়ালেন একটু উঁচু সিমেন্টের বেদীতে। চারিদিকে দোকান পাট, জে এন ইউ এর ছাত্র ছাত্রীরা, কল সেন্টারের তরুণ তরুণীরা। তিনি শুরু করলেন তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে তার বক্তৃতা। যারা নতুন, তারা দাঁড়িয়ে গেল, যারা গত বিশ বছর ধরে শুনছেন ও দেখছেন, তারা নিঃস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দেখে চলে গেল যার যার কাজে।টানা দশ মিনিট না থেমে ইংরাজি ও হিন্দীতে তার বক্তৃতা শেষ করলেন। নেমে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কেমন আছি, কেননা কুড়ি বছরের জানাশোনা। কথা হয় না খুব একটা, কিন্তু ওনার লেখা তৃতীয় বিশ্ব সংক্রান্ত পোস্টার নিয়মিত পড়ি এটা উনি জানেন। শুনেছি জে এন ইউ তে গবেষণা করতেন এক সময়। ষড়যন্ত্রের শিকার হন, কেউ পুরো থিসিসটা টুকে মেরে দিয়ে ডক্টরেট করে। দু বার উনি সিভিল সার্ভিস মেইন্স উত্তীর্ণ হয়েও ইন্টার্ভিউ তে আটকে যান। আজ ফুটপাত আস্তানা। রম রম করে যে কাফেটা চলছে ওখানে, তারাই ওকে খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। ভাল থাকলে ছাত্র ছাত্রীদের থিসিস লিখে দু পয়সা পান। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে আর ফিরে যান নি। আমাকে বললেন উনি প্রতি শনিবার বট গাছ তলায় সন্ধ্যে ছটায় নারী সুরক্ষা নিয়ে আলোচনার আসর বসান। আমন্ত্রণ থাকলেও আজ পর্যন্ত যাওয়া হয় নি।

মনের মতো পাগল পেলাম না, আমি তাইতে পাগল হলাম না।

হাল ক্যায়সা হ্যায় জনাব কা?

দিল্লীতে, অফিসে বা রাস্তায়,  পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে সৌজন্য দেখান হয় এই বলে , “কেয়া হাল হ্যায়! সব ঠিক?’ বলেই তারা আর প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করে এগিয়ে যায় একটু হেসে, কিম্বা ছুয়ে যায় আঙ্গুলে আঙ্গুল। দুরত্বটা বেশি হলে বড়জোর ঘাড় বেকিয়ে  হাতটা তোলে ছোট্ট করে। এখানে যে সবাই ছুটছে, কারো সময় নেই! বড্ড তাড়া।

জাপানের লোকেরা শুনেছি বেজায় ভদ্র। অর্ধ নত হয়ে নিঃশব্দে “আরিগাতো” করে হাসিমুখে। আমেরিকায় ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে কর্মরত বন্ধু বলেছিলেন অফিসের সহকর্মী করিডোরে চিনতে পারে না, কিন্তু নিজের টেবিলে গিয়ে মেল বক্সে জানায় “হাই, গুড মর্র্নিং”

আমরা, বাঙালীরা, পরের ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ। পরিচিতদের কারোর “কেমন আছেন” এর উত্তরে যদি বলি, “দারুণ”,  কাছে এসে বলে, “দারুণ মানে? বি-পি টি-পি, আর সুগার সব ঠিক তো……”, থামিয়ে দিয়ে বলি , “আরে না না ওসব ঠিকআছে……” কাছাকাছি মুখ নিয়ে এসে বলে, ” চেক আপ সব করাবেন, …।।বয়স টা তো…”

বলে দিলেই হয়, ” আপনার কী মশাই, নিজের বয়সও তো ওই……।”। সেসব কিছুই না বলে হাঁটা দিই।

কিছু মানুষের মনে হয় সবসময় তারা অসুখে ভুগছে বা কোন অজানা অসুখ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য, এই বুঝি হামাগুড়ি দিয়ে ধরল এবার। সেই জাতের লোককে যদি জিজ্ঞেস করি, ” কেমন আছেন?” , মুখের সব আলো নিভিয়ে তিনি জবাব দেন, ” আর বলবেন না, আমার আজকাল বুকটা থেকে থেকে ধড়াস ধড়াস করে, মাথাটাও কেমন যেন—-“।

আমার এক আত্মীয়া আছেন, যাকে ফোন করে খোঁজখবর নিলেই অপর প্রান্ত থেকে জবাব আসে, “আর বলিস না, সেই পুরনো মাইগ্রেনটা বড্ড জালাচ্ছে,সব সময় মাথা ঝনঝন……।।” তারপর একপ্রস্থ রোগের ফিরিস্তি।

এবার থেকে ভাবছি আগের থেকে একটা রোগের লিস্ট বানিয়ে রাখব আগে ভাগে, যাতে যথাসময়ে যথাযথ প্রয়োগ করতে পারি।

বর্ষা কালের ব্যাঙ

বর্ষা কালে ডাকত ব্যাঙ, গ্যাঙর গ্যাং,গ্যাঙর গ্যাং। বিছানায় শুয়ে শুনতে পেতাম কচুপাতায় টিপ টাপ পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। জানলা দিয়ে বৃষ্টির গুঁড়ো ঢুকে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার চোখ আর মুখ । জানলা বন্ধ করতাম না। অন্ধকার মুড়ি দিয়ে শুনতাম ব্যাঙের ডাক। বিভিন্ন ব্যাঙের বিভিন্ন ডাক। কতগুলো ডাকত কট কট শব্দে, তার মাঝে সঙ্গত ধরত কোলা ব্যাং, সে ডাকত গ্যাং গ্যাং করে। সামনের রাস্তায় জমা জল, নীল রঙা রাস্তা দিয়ে সপ সপ শব্দে কে যেন টেনে টেনে হাঁটছে।

বৃষ্টি যত বাড়ে, ব্যাঙের ডাকও তীব্র হয়। মশারি উড়ছে বৃষ্টি ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়ায়। শীত বাড়ছে বুকের ভিতর। কচুপাতার উপর এবার জলের শব্দ সর সর করে পড়ছে কারনিশ বেয়ে। হাওয়ার সোঁ সোঁ আওয়াজ আরও বাড়ল। হাওয়ার ঝাপ্টায় কার বাড়ির জানলা ঝাপটে পড়ল সশব্দে। চরা চরে কোথাও আর কোন শব্দ নেই। বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে ডেকে চলেছে ব্যাঙের দল। খোলা জানলা দিয়ে সামনের নারকেল গাছগুলো দেখা যাচ্ছে। ওরা বৃষ্টি-হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে নাচছে।

মনে হল ঘরের মধ্যে কি যেন একটা দুলে উঠল! বুকের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেল একটা ঠাণ্ডা স্রোত, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। নাঃ, মনের ভুল। দেওয়ালের পেরেকে

লাগানো আমার পাঞ্জাবী নড়ে উঠল হাওয়ায়। চোখ বন্ধ করে শুনছি বৃষ্টি আর ব্যাঙের আওয়াজ। ঠাণ্ডা হাওয়ায় চোখ জুরিয়ে এল।

download

আজ হারিয়েছি সেই বৃষ্টি মুখর রাত, যখন ব্যাঙের ডাক শুনে চোখ জুড়ে নেমে আসত ঘুম।