চড়ুইভাতি

sparrow
একটা ঝুড়ি, ঝুড়ির মাথায় বাঁধা একটা লম্বা সুতো। ঝুড়িটা উপুড় করা একটা ইটের সামনে। সুতো আর ইটের অবলম্বনে আধ খোলা। লম্বা সুতোটা চলে গেছে ছাতের চিলেকোঠার জানলা বরাবর। জানলায় একটি বালক। অপেক্ষায়, কখন ঝুড়ির নিচে রাখা গমের দানাগুলো খেতে দু চারটে চড়াই চলে আসে। ছাতের রেলিঙে চড়াই দুটো লাফ দিয়ে দিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। উড়ে আসে ছাতের উপর। নেচে নেচে কিচির মিচির করতে করতে ঝুড়ির নিচে আসতেই জানলায় বসে থাকা বালকটি সুতো কেটে দিল। চড়াই দুটো ধরা পড়ল। ছেলেটা নেমে এল চিলেকোঠার ঘর থেকে। ঝুড়ির ফুটো গুলো দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে নিল চড়াইগুলোকে। তারপর ঝুড়ি তুলে দিতেই পাখি দুটো উড়ে গেল ফুড়ুত করে, আকাশে। ছেলেটা চোখে হাত রেখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল চড়াইদের গমনপথে।

উপরের খেলাটা খেলতে ভাল লাগত। খেলাটা বন্ধ হল সেদিন, যেদিন সুতো কেটে দিতেই ঝুড়ি বন্ধ হল চড়াইয়ের ডানার উপর। চড়াইটাকে জল দিতে কিছুক্ষন ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। শুকতারায় পড়েছিলাম “চড়াই পাখীরা কোথায় যায়”। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম। সত্যি তো, চড়াই পাখী মারা যেতে দেখা যায় না তো! দুর্ঘটনার শিকার না হলে চড়াইকে মরতে দেখেছে কে? সাহিত্যিকের কল্পনায় চড়াই পাখী যখন অসুস্থ হয়, তখন সে চলে যায় একটা পাহাড়ের মাথায়। অপেক্ষা করে কখন মৃত্যু তাকে কাছে টেনে নেয়। কিন্তু বড় হয়ে বুঝলাম চড়াই অত উপরে ওড়ে না, সমতলেই তার আনন্দ, মানুষই তার প্রিয়। বলছি হাউস স্প্যারোর কথা। চড়াইয়ের আছে অনেক রকমভেদ। সে দিয়ে কাজ নেই, চড়াই আমাদের অনেকের জীবনেই নিত্য সঙ্গী ছিল।

চড়াই মানুষ ছাড়া থাকবেই বা কি করে! তার চাই শস্য খুঁটে খাওয়া, শস্যের ভাঁড়ারের কাছেই তার বাস। আর প্রিয় খাবার ঘাস পোকা। তখন ছিল বড় বড় বাড়ি, বাড়িতে ছিল ঘুলঘুলি। আমাদের বাড়ির ঘুলঘুলিতে ছিল জাফরি লাগানো। ঘাস বিচুলি, কাঠ কুটো দিয়ে চড়াইগুলো বন্ধ করে দিত ঘুলঘুলি, আর তাতেই সংসার পেতে বসত। একদিন ঝুল ঝাড়তে গিয়ে পাখির বাসা মাটিতে পরে তিনটে ডিম ভেঙে যাওয়ায় কি আফসোশ! চড়াই নাকি জাতে বাউন্ডুলে।সঙ্গী বা সঙ্গিনী জুটলে ভাল, না জুটলে কুছ পরোয়া নেহি। জীবন সঙ্গিনী জুটলে নানা বায়নাক্কা, ঘর বানাও, ডিম পারো, বাচ্চা মানুষ…..না না, চড়াই করো। তাকে ঠোঁটে করে খাবার এনে খাওয়াও। অনেকে এসব ঝামেলায় না থেকে নিম কিম্বা অশথ গাছে থেকেই জীবন কাটায়। চড়াই কিছুটা জীবন নিয়ে যেন উদাসীন, সারাদিন নাচে নেচে খুঁটে খুঁটে খাওয়াতেই তার দিব্যি চলে যায়। বৎসরান্তে যে পিকনিক করে মানুষ, তার বাংলা নাম চড়ুইভাতি, মানে জলে জঙ্গলের ধারে একটা দিন চড়ুইয়ের মত ভাত খুঁটে খাওয়া?

চড়াইয়ের নিন্দায় পঞ্চমুখ হলেন কবি যতীন্দ্র মোহন, বাবুই এর সাথে তুলনা করে ফেললেন।

বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
“কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
আমি থাকি মহা সুখে অট্টালিকা পরে
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টির, ঝড়ে৷”
বাবুই হাসিয়া কহে, “সন্দেহ কি তায়?
কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়৷
পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা৷”

ব্যস, রাতের ঘুম গেল, বাবুইয়ের বাসা দেখতে হবে। বাড়ির কাজের লোক নিয়ে এল বাবুইয়ের বাসা, কোথা থেকে কে জানে? কি সুন্দর! কি শিল্প!কবি তো এ দেখেই লিখে ফেলেছিলেন ওই সুন্দর কবিতাটা, যেটা বুকের গভীরে বিঁধে গিয়েছিল আমূল।

চড়াইরা আর আসে না। গ্রাম দেশে আসে। বহুতল বাড়ি চড়াইয়ের নাগালের বাইরে। কংক্রিটে ঢাকা পরে গেছে ঘাস। শহুরে বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারে না ছোট্ট বুকগুলো। আরও জমি হাতাও কৃষাণের, বানও বহুতল ইমারত, মেট্রো, রেসিং ট্র্যাক, বিনোদন পার্ক, যেখানে কলের পাখি গান গাইবে, ডানা ঝাপ্টাবে, কিন্তু গমের দানা খেতে কোনোদিন নেমে এসে আবাক করে দেবে না কোন শিশুকে। দুই হাত বাড়িয়ে “দাও ফিরে সে অরন্য” বলে কি লাভ? সে তো সাহিত্যেই মানান।

ছবি সৌজন্য – অন্তরজাল