সবে তখন চাকরিতে যোগ দিয়েছি। আশারাম নামে একজন নেপালী হেল্পার পেলাম ল্যাবে সহায়তার জন্য। আমারি মত সেও একজন সরকারী চাকুরে এবং স্থায়ী। গাট্টা গোট্টা বেঁটে চেহারা, চোখদুটোতে বেশ বুদ্ধি দীপ্তি। বয়স এই আমারি মত।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে জিজ্ঞেস করত হটাৎ করে, ” চায়ে লাউঁ সাব?”। আমার আবার বেজায় চায়ের নেশা। তাই সমবয়সী এই যুবকটি কয়েকদিনেই আমার বেশ কাছের লোক হয়ে উঠল। সহকর্মীরা সাবধান করে দিলেন, আশারামের আশার ছলনায় যেন না ভুলি। সে নাকি টাকা ধার করে ফেরত দেয় না। আর বেজায় ‘দারুর’ নেশা। পেটে খাবার না থাকলেও চলবে, চলবে না সুরার খোরাক না থাকলে। লক্ষ্য করলাম, সারাদিনই সে নেশায় থাকে। কিন্তু জাতে মাতাল হলেও কাজে ঠিক। কোন মেশিন কি কাজে আসে, কোন মেশিন বিগড়ালে শব্দের পরিবর্তন কেমন হয়, সে সব তার আঙ্গুলের ডগায়। কাজেই সে এক অপরিহার্য মানুষ। সে যে এমনিই ভাল ছেলে, কি আর যায় এসে ‘মাঝে মধ্যে’ নেশা টেশা করলে।
মাস ফুরোলে তখন ক্যাশে পে করা হত মাসমাইনে। ক্যাশিয়ার টাকা গুনছে গোমড়া মুখে, কাউন্টারের বাইরে আশারামকে ঘিরে কিছু মানুষের ভিড়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা। জানা গেল প্রতি মাসে আশারাম টাকা ধার নেয় এর ওর কাছে, মাসমাইনের দিনে উত্তমর্ণের দল কলার ধরে টাকা আদায় করে। সব বিলানোর পর ওর হাতে কিছুই থাকে না, আবার দু তারিখ থেকে ধার শুরু। এ ভাবেই চলতে থাকে তার জীবন। শুনলাম একবার মাইনের থেকে বেশি ধার করায় দু একজনের ধার বাকী থেকে যায়, তারা অফিস ছুটির পর আশারামের জামাকাপড় কেড়ে নেয়। কাজেই অনেক রাতে সে শুধু ‘কাচ্ছা’ পড়েই বাড়ি ফেরে।
একদিন জিজ্ঞাসা করলাম এ ভাবে ওর চলে কি করে! হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে বলল, ‘চলতা হ্যায় সাব – এয়সেহি, আপলোগো কি সমঝ কি বাত নেহি হ্যায়’। শুধালাম ওর ‘বিবি, বাচ্চা’ আছে কি না। বলল, বউ ওর থেকে পাঁচ বছরের বড়, ছেলে মেয়ে চারটি – কেউ স্কুলে যায় না। বউ আবার ‘দারু’ না পেলেই ওকে বেজায় পেটায়। দেখলাম মুখে একটা সলজ্জ সরল হাসি ঝুলে।
দু দুটো মেশিন চলছে একসাথে। চারজন একসাথে গভীর মনোযোগে কাজ করছি। হটাৎ একটা মেশিনের আওয়াজ থেমে যেতে বিরক্ত হয়ে দেখি, আশারাম মেশিনের সুইচ অফ করে মেশিনের নীচে কিছু দেখছে। বলল, শব্দ শুনেই বুঝেছিল আর কিছুক্ষন মেশিন চললে গীয়ার বক্স ভাঙত। অঘটনের হাত থেকে সেদিন বেঁচেছিলাম তার দক্ষতার জন্য। পিঠটা আলতো চাপড়ে দিতেই হাত বাড়াল, ‘এক পচাস কা নোট দো না সাব!’ তখন সেই ‘পচাস’ অনেক টাকা। দিয়েই দিলাম। এবং ফেরত পাবার আশা ছেড়েই। চমকে দিল মাস পয়লায়। দেখি আশারাম দৌড়তে দৌড়তে আসছে। পিছনে দু জন আরও ছুটছে। ভাবলাম পাওনাদারেরা তাড়া করেছে বোধহয়। কাছে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে হাত বাড়িয়ে পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে বলল, ‘লো সাব, আপকা রুপেয়া’। পিছনে তাড়া করে আসা দুজন তখন থমকে দাঁড়িয়েছে। ওদের লোলুপ চোখ টাকাটাকে গিলছে। বললাম, সে হয় না আশারাম, ওদের টাকা আগে ফিরিয়ে দাও। সে দম নিতে নিতে বলল, ‘আপস কি বাত হ্যায় সাব, হাম কর লেঙ্গে হিসাব কিতাব বাদ মে…।।’ টাকাটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, ফেরত পাবার আশাই যে করি নি! পঞ্চাশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমি বেবাক সেদিন – একা।
একদিন সকালে ল্যাবে কাজ করার জন্য আশারামকে ডেকেও পেলাম না। অনেক পরে মূর্তিমান এসে হাজির আমার কাছে, কিছুটা ঢিলে ঢালা অবস্থা। দেরী হবার জন্য একপ্রস্থ গালাগাল খাওয়ার পরও মুখে হাসি না দেখে অবাক হয়ে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায়, অশ্রুসজল চোখে বলল, তার ‘বিবি’ গতকাল রাতে পালিয়েছে তারই বড় ভাইয়ের সাথে। এই পরিস্থিতিতে কি ভাবে স্বান্তনা দিতে হয় তখন জানা ছিল না। শুধু পিঠটা চাপড়ে দিতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,’কোই বাত নেহি সাব, আচ্ছা হ্যায়, জানে সে পহলে বাচ্চোকো লে কর গয়ী। কৌন করে দেখভাল!’। দু মাস পর শুনলাম আর একটা বিয়ে করেছে। দু চার দিন জামাকাপড়ের চকচকে ভাব কারো চোখ এড়াল না। মহিলা কর্মীরা মুখ টিপে হেসে নিলেন কদিন। দু চার দিন পর আবার পুনরাবস্থা। টাকা ধার, ময়লা জামাকাপড়, সব এলোমেলো।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে শুনি নতুন বউও পালিয়েছে। এবার আশারামের শরীর ভেঙে পড়তে লাগল। মদ্যপানের মাত্রাও বাড়ল। কাজ করতে করতে হাঁফাত। মাঝে মধ্যে পেট চেপে ধরত। প্রচণ্ড কাজ এল ল্যাবে। কাজের মধ্যে একদিন শুনি মেশিনেকে গালাগালি করছে। মনে হল হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বললাম বিশ্রাম নিতে। বলল, ‘কাম করণে কে লিয়ে সরকার তনখা দেতি হ্যায় সাব, ম্যয় ঠিক হু’। কাজ শেষ হলে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল আমার কাছে এ যাবত কত টাকা ধার নিয়েছে। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, ‘কিতনা বাতা দিজিয়ে, ম্যায় ওয়াপস করনা চাহতা হু’। লিখে রাখিনা তাই বলতেও পারলাম না। পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝে খুঁড়তে খুঁড়তে বলল ,’এক বিশ কা নোট দো, পুরানা হিসাব কা সাথ জোড় লেনা’।
এক শীতের সকালে অফিসে ঢুকতেই সহকর্মী খবর দিল আশারাম গুরুতর অসুস্থ। একা থাকত। প্রতিবেশী হাসপাতালে দিয়েছে। কিছু লোককে পাঠান হল হাসপাতালে। আশারামকে পাওয়া গেল না। প্রথম বউ মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে। কোথা থেকে আশারামের অসুস্থতার খবর পেয়ে সেবার অভিপ্রায়ে ফিরে এসেছে। ভাবলাম কি বিচিত্র মানুষের মন। ‘একি অপূর্ব প্রেম দিল বিধাতা!’ ঘর জ্বালানী পর ভুলানির মন প্রেমের বাতাসে ভেসে উজান পাড়ি দেয়। নিন্দুকে বলল দ্বিতীয় বউয়ের সাথে আশারামের নাকি বিয়েই হয় নি।গরীবের লিভ ইন, ভেবে নিজেই মনে মনে খানিক না হেসে পারলাম না। “ম্যারেজ ইস এন ইন্সটিটিউসন” – ব্যর্থ হয়ে ভেঙ্গে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে।
তিনদিন পর অফিসে আশারামের প্রথমা এল আমার কাছে। ক্ষয়াটে চেহারার মধ্যবয়সী রমণী, ধূর্ত চোখে লোভ চিক চিক করছে। আসবার উদ্দেশ্য সরাসরি জানিয়ে দিল। স্বামী মরলে কত টাকা পাওয়া যাবে।বিরক্ত হয়ে বললাম, আমার কাছে কেন, একাউন্টস ডিপারমেন্টে যাও। জানা গেল আশারাম আমার কাছে খোঁজ নিতে বলেছে। তদ্বির করার লোকের আভাব হল না।অসুস্থ স্বামীকে দিয়ে কাগজে সই করিয়ে পি এফ থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেল, ‘ইলাজের’ আছিলায়। যাকে পতি প্রেম বুঝেছিলাম, তা মিথ্যে প্রমান হয়ে নিজের কাছে যেন হেরে গেলাম।
কদিন পর ‘দাওয়া’ না পেলেও ‘দারুর” প্রভাবে আশারাম তার ‘উধারী দুনিয়া’ থেকে মুক্তি পেয়ে গেল। শ্মশানে মৃতের বুকের উপর কাঠ চাপানো হল একটার পর একটা। যেন ঋণের বোঝা । ইচ্ছা হল সরিয়ে দিই। বড় কমজোর ছিল ওর বুক। পুড়তে থাকা শরীরের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে উঠল। বুকে হাত দিতে পকেটের দশ বিশ পঞ্চাশের নোটগুলো খর খর শব্দ করে উঠল।
মনে হল পিছন থেকে কে যেন মৃদু স্বরে বলল,’এক পচাস কা নোট দোগে সাব? আগলা তনখা মে লে লেনা…।’