তখন আমি দশম শ্রেনী, আমি তখন ষোল –
বাবার সাথে বেড়াতে গেছি বেনারস। তীর্থে নয়, আমার বাবা যেহেতু রেলের পাশ পেতেন, তাই বৎসরান্তে আমারা মাঝে মধ্যে বেড়িয়ে পরতাম এখানে সেখানে। বেনারসের ধর্মশালা থেকে বেরতেই ঘোরাঘুরির জন্য নিতে হল রিক্সা।
বাবা নিখুত বাংলাতেই রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এই রিক্সা যাবে?”
খাঁটি বাংলাতে জবাব এল, “যাব বাবু, আসন গ্রহণ করুন”।
রিক্সায় উঠব কি, ভাষা শুনে থমকে দাঁড়িয়েছি। এ ব্যাটা বলে কী! এত বিশুদ্ধ ভাষা, তার উপর আবার রিক্সা চালায়!
আমদের চক্ষু চড়গ গাছের মগডালে দেখে একটু হেসে বলে, “কালক্ষেপ করবেন না বাবু, বেলা দ্বি প্রহর হল। সব পরিক্রমা করতে হবে তো।”
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন,” তা কত দিতে হবে তোমাকে, ইয়ে আপনাকে?”
-“আমি রিক্সা চালাই বাবু। ওই তুমিতেই অধিষ্ঠাণ করুন”।
-“কত দিতে হবে তো বল!”
-“আপনি বিবেচক, খুশী হয়ে দিয়ে দেবেন যা হোক…”
-বি এইচ এউ তে নিয়ে চল আগে” বাবা বলে।
-“বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় বলছেন বাবু?”
-“বি এইচ ইউ ত হল।
-“না, আমরা ত হাওড়া জেলার লোক, তাই শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত।”
-“সে তো দেখতেই পাচ্ছি”।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, “বাড়ি কোথায়?”
-“আজ্ঞে!”
-“বলছি কোথায় নিবাস?”
-“হাওড়া জেলায় বাবু…”
-“হাওড়ায় কোথায়?”
-“বাগনান”
-“ও বাবা, সেখানে আমার এক শালী থাকে যে!”
–“শ্যালিকা? কোন জায়গায়?”
-“সে তো ভুলে গেছি বাপু। তার বিয়ের সময় গেছি, সে কত বছর আগে মনেও পরে না। বেজায় মশা সেখানে…”
– “রেতে মশা দিনে মাছি,
এই তাড়্য়ে কল্কেতায় আছি।”
-“বল বাগনানে আছি”
-“ওই হল যা হোক”
কখনো ডান দিক কখনো বাম দিকে শরীর বাঁকিয়ে এই পা, ওই পায়ের ভরে প্যাডেলে চাপে রিক্সা চলে অলি গলি দিয়ে। হঠাত মোড়ের মাথায় বাঁক নিতেই বাবা আঁতকে উঠলো, “একি তোমাকে যে বি এইচ ইউ তে আগে নিতে বললাম…..”।
-“আরে বাবা বিশ্বনাথের মন্দির দেখে যাবেন না আগে? ওটাই আগে পড়বে…”
-“তোমাকে যেদিক দিয়ে যেতে বলছি সেদিক নাও, কাশীর রাস্তা আমাকে চিনিও না”
রিক্সা চালকের মুখ ভার। সে হয়ত বিশ্বনাথের মন্দিরে আগে নিয়ে গিয়ে দুটো পয়সা পেতে চেয়েছিল।
ব্যজার মুখে রিক্সার মুখ ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, “বাবু কি রাগান্বিত হলেন?”
বাবার অবস্থা হাসে না কাঁদে। বলে, “লেখাপড়া কদ্দুর করেছ হে?”
-“কলেজে নাম লিখিয়েছিলাম ম্যাট্রিকের পর। পড়াশুনোতে খারাপ ছিলাম না। দরিদ্রের আবার বিদ্যার্জন”।
-“বিয়ে করেছ?”
– “আজ্ঞে হ্যাঁ”
-“বউ বাচ্চা এখানে থাকে?”
-“না বাবু। সাথে রাখলে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রী”
মনে হল বাংলার মাস্টারমশাইয়ের সাথে চলেছি রিক্সা চেপে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বনাথ মন্দির, দশাশ্বমেধ ঘাট, মনিকরণ ইত্যাদি ঘুরে ফিরে এলাম। সমস্যা হল রিক্সার ভাড়া দেবার সময়। বকসিসে খুশী করা গেল না বঙ্গ পুঙ্গবকে। বেঁকে বসল। অনেক টানাপোড়নের পর নিমরাজি হয়ে রিক্সায় চড়ে বসে প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলে গেল, “বাবু কি রাগান্বিত হলেন?”