ইলিশের বাঙালী

ইলিশের আমি ইলিশের তুমি, ইলিশ দিয়ে যায় চেনা। কাকে আবার, আমাদের বাঙালীদের! ইলিশ না খেলে হবে না বাঙালী। বাঙালীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে , রক্তে রক্তে ইলিশ।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন-

‘ইলশে গুঁড়ি!   ইলশে গুঁড়ি ইলিশ মাছের ডিম|

ইলশে গুঁড়ি  ইলশে গুঁড়ি দিনের বেলায় হিম|’

বর্ষা এল তাই কবিও দেখছেন ইলিশ মাছের নাচ- ‘হালকা হাওয়ায়  মেঘের ছাওয়ায় ইলশে গুঁড়ির নাচ’।নাচ বলে নাচ, মাছে ভাতে বাঙালী নাচে ইলিশের গন্ধে।

আহা, কোথায় সে দু কিলো ওজনের এক একটা ইলিশ। তেলে হাত পিছলে যাওয়া, একদিন খেলে দু দিন হাতে বয়ে বেড়াতে হত সে সুগন্ধ। দু কিলোর মাছ কাটছে মাছমারা, আঁশ ছাড়িয়ে মুড়ো আর ল্যাজা কেটে লম্বা লম্বি দিল চিড়ে। তারপর দুটো সানকিতে মাছ দু ভাগে রাখছে, পেটি আর গাদা। দুজন ক্রেতা নিবিষ্ট হয়ে মাছকাটা দেখছে, ভাগে কম পড়ল না তো!বাড়ি ফিরে মাছের থলে হাতে নিয়ে গিন্নির প্রফুল্ল বদন, পেটি দিয়ে ভাপে আর গাদাগুলো পাতুরি। সে সব খেয়ে কেয়া বাত কেয়া বাত।

এ জন্যই বোধহয় বুদ্ধ কবি লিখেছিলেন-

‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে

জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,

নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।

তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ;

কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁজে।

এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব’

ছোট বেলায় স্কুল যেতে একটুও ভাল লাগত না।সকাল বেলায় একদিন ঘুম ভেঙে দেখি কলতলায় বিশাল এক ইলিশ নিয়ে বসে আমার মা। সেই গাদা পেটি আলাদা হচ্ছে। আমার সোজাসুজি ফরমান- স্কুল যাব না। বাবা মৃদু হেসে আমাকেই সমর্থন করাতে ‘কি আনন্দ কি আনন্দ!’ ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলায় আমরা বাড়ির সবাই একদিকে আর আমার বাবা আর একদিকে, আমরা ইস্টবেঙ্গল আর বাবা মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গল জিতল, বাবা বাজারে গিয়ে ব্যাজার মুখে হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরল, হাতে দুটো ইলিশ।  আমরা হই হই করে উঠলাম। প্রিয় টিম হেরে গেলেও আমাদের মুখে হাসি ফোটাতে বাবার মুখেও হাসি। সত্তরের দশকে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এলেন বাবার বন্ধু ।উঠেছিলেন ক্যম্পে। কয়েক দশক পর আমাদের বাড়ি ঠিকানা খুঁজে, পুরোন বন্ধুর সাথে দেখা। হাতে ঝুলিয়ে আনলেন একটা মুখে দড়ি বাঁধা রুপোলী ইলিশ আর একটা আস্ত কাঁঠাল।  ঘরছাড়া দিশাহীন মানুষ, তবু বন্ধুর জন্য উপহার। দুজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আপ্লুত। মায়ের হাত ধরে ইলিশের প্রস্থান রান্নাঘরে।

রবি কবি ইলিশ ভাল বাসতেন না নিশ্চয়। না হলে তার লেখায় ইলিশ অনুপস্থিত কেন? ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’ তে কিন্তু আছে ইলিশ মাছের রেসিপি। নজরুলও লেখেন নি ইলিশের কথা। এঁরা কি বাঙালী ছিলেন না? না, কথা হচ্ছে আমাদের মত আটপৌরে বাঙালীদের নিয়ে। একজন উচ্চপদস্থ বাঙালী কে একবার আফসোস করতে শুনেছিলাম, ‘ইস কতদিন ইলিশ খাই না! যা দাম!’ না, দামের কথাটা আছিলা। পরে শুনেছি ওনার গিন্নি ইলিশের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না।

এখন যে ইলিশ পাওয়া যায় সেটাকে একসময় বলা হত – খোকা ইলিশ। খুকি ইলিশ নয় কেন কে জানে! খোকা হোক বা খুকু হোক, ডিম না হলে আবার ইলিশ কি! (পুরুষ ইলিশও কি ডিম ছাড়া মেয়ে ইলিশ পছন্দ করে?) সাড়ে চারশো গ্রাম ওজনের ইলিশে ডিম কোথায়? নোনা জল থেকে মিষ্টি জলে এলে মাছ গায়ে গতরে বড় হয়, ডিম দেয়, ডিম ছাড়ে, ছানাপোনা হয়, উলটো স্রোত পাড়ি দিতে ধরা পরে, তারপর না তার স্বাদ! একে নিয়ে বাঙালীর যত গল্প যত মান – আভিমান – আবেগ।

একহাজার ইলিশের পদ নিয়ে বই লিখেছেন লন্ডনের বিখ্যাত এক সেফ, বাসস্থান বাংলাদেশ। তার ভূমিকা লিখেছেন হুমায়ুন আহমেদ সাহেব। পদ্মা নদীর মাঝি সিনেমায় হত দরিদ্র নায়ক পান্তা ভাত খাচ্ছে ইলিশ ভাজা দিয়ে, সারাদিনের নামে খাওয়া যে! এখন সেই দুকিলো ওজনের মাছগুলো দিয়ে ইফতার পার্টি করছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। খোকা খুকু ইলিশ কিনতে কিনতে মাসের শেষে আমাদের জীবন নিয়ে টানাটানি।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s