রতনে রতন চেনে……।

রতন টাটা বলেছেন – ‘ জীবনটাকে অত সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন নেই, জীবন আজ আছে কাল নেই।’ কথাটা দৈনিক নিত্যানন্দে ছাপা হয়েছে। আজ তুমুল একচোট আলোচনার ঝড় বয়ে গেছে বাজারের মোড়ে চায়ের দোকানে। আমাদের পাড়ার রতনদা, যে নাকি ফায়ার ব্রিগেডে কাজ করে, যার ভাইয়ের একটা আটা পেষার দোকান আছে, সে কথাটা শুনল সাত সকালে চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে। কথাটা মাথায় ঢুকে একেবারে গেথে বসে গেল। রতন দা এরপর তিন মাথার মোড়ের সার্বজনীন কলতলায় গেল দাঁত মাজতে। কল পাড়ে দাঁড়িয়ে পাড়ার মেয়ে বউ। রতন দা একমনে রতন টাটার কথাগুলো গভীর ভাবে ভাবতে ভাবতে একমনে দাঁত মাজতে মাজতে জল ভরা দেখছে। জল ভরছে একটি সদ্য স্কুল ছাড়া মেয়ে।রতন দার দৃষ্টি একেবারেই তাকে অনুসরণ করছিল না।কিন্তু মেয়েটির মা অন্য কিছু ভেবে রতন দার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে খড়গহস্ত হলেন। ব্যাস শুরু হল এক দক্ষযজ্ঞ। রতন দার ধ্যান যখন ভাঙল, ততক্ষণে রতন দার বউ সিনে। তিনিও কম যান না। চোখা চোখা বানে সব্বাইকে বিদ্ধ করে রতন দা কে টেনে নিয়ে গেলেন ঘরে।

রতন টাটা বলেছেন ‘ জীবন এই আছে এই নেই, জীবন থেকে বেশি আশা করা নিরর্থক’। রতন দা তাই দু মুঠো পেটে ঠুসে, গণ পিটুনি খাওয়া সারমেয় সদৃশ মুখে, রওনা দিল আপিসে। গিয়েই শুনল কোথায় যেন আগুন লেগেছে। বেরতে হল টাং টাং বাজিয়ে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ির মাথায় ত্রিশঙ্কু হয়ে। বাজারে আগুন। লাফ দিয়ে সবাই নামলেও, রতন দা নট নড়ন চড়ন। মাথায় ঘুরছে রতন টাটা বলেছেন – ‘ জীবনটাকে অত সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন নেই, জীবন আজ আছে কাল নেই।’ সবার ডাকাডাকিতে সাড়া না দেওয়ায় ফল হল ফিরে এসে কাজে গাফিলতির জন্য শো কশ নোটিস।

আমাদের পাড়ার মন্টু, যে ফুটবল মন্টু বলে পরিচিত, এক সময় সে ভাল ফুটবল খেলত বলে, সেও আজকের খবরটা চায়ের দোকানে শুনে আসার পর থেকে আর স্থির থাকতে পারছে না। রতন টাটা বলেছেন, ‘ বছরে ৫০ টা উইক এন্ড। আনন্দ কর।’     ইস সব নষ্ট, ভাবে মন্টু। আজ শনিবার, তাই পনের বছরের রেলের শান্ট ম্যানের কাজে যেতে হবে না। বাড়ি ফিরে মন্টু শুয়ে পড়ে। চোখটা লেগেছে কি লাগেনি, গিন্নির প্রবেশ। ‘বলি শুয়ে থাকলে কি চুলো জ্বলবে? বাজারে কে যাবে?’ মন্টু মটকা মেরে শুয়ে থাকে আর ঠিক করে আজ বাজারে যাবেই না। রতন টাটা বলেছেন, ‘জীবন উপভোগ কর’। মেয়ে এসে বলল, ‘ বাবা মা বলছিল বাজারে না গেলে রান্না হবে না। ‘ মন্টু কেতরে শুয়েই থাকল, ওঠার লক্ষণ নেই দেখে মেয়েও সরে পড়ল। বেলা বাড়তে মা মেয়েতে চলে গেল মন্টুর শ্বশুর বাড়ি।শুয়ে শুয়ে মন্টু স্বপ্ন দেখে একটা সে রেলের অফিসার হয়েছে…

বিষ্টু দা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কেরানি। মাথায় টাক, মধ্যস্থল স্ফীত। তিনটি মেয়ে, আর সাহস হয় নি। একটির বিয়ে দিয়েছেন্  বনহুগলীতে। আর দুটি সেলাই শেখে। অফিসে এসে এক গ্লাস জল খেতেই, ধপাস করে কাগজটা ফেলে দিল টেবিলে, অফিসের ফিচেল মিত্তির। ‘রতন টাটা কি বলেছে পড়েছেন?’ বিষ্টু দা সকালে খবরের কাগজ পড়ার আর সময় পান কখন! ঝোলা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে লালগোলা এক্সপ্রেস ধরতেছোটা, তারপর শিয়ালদায় নেমে দু মাইল হেঁটে বা ছুটে অফিস। দৈনিক নিত্যানন্দে খবরটা লিখেছে বেড়ে। বেশ রসিয়ে রসিয়ে। আহা, এতবড় সংস্থার কর্ণধার, কি ব্যক্তিত্ত, কি বাচন! বিষ্টু দার মন ছুঁয়ে গেল। আড় চোখে নতুন তরুণী  টাইপিস্টের দিকে তাকালেন। গলাটা শুকিয়ে গেল। এক ঢোঁক জল খেয়ে ভাবলেন, রতন টাটা বলেছেন, ‘প্রেমে পড়, দরকার পড়লে একটু বউয়ের সাথে একটু ঝগড়া…।’ ঝগড়া তো নিত্যসঙ্গী, প্রেমে পড়লে কেমন হয়? নিজের মুখটা টেবিলের কাঁচে একটু দেখে নিলেন। নাঃ,  টাকটা একটু বেশিই প্রশস্ত মনে্ হল, প্রেমে পড়ার জন্য অন্ততঃ।ভাবতে লাগলেন রতন টাটা বলেছেন – ‘ জীবনটাকে অত সিরিয়াসলি নেবার প্রয়োজন নেই, জীবন আজ আছে কাল নেই।’ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন নিজেই জানেন না। পিওন এসে ডাকায় সম্বিত ফিরল, ‘বিষ্টু দা , স্যার ডেকেছেন চেম্বারে’। বিষ্টু দা ঘামতে ঘামতে চেম্বারে যেতেই সাহেবের ধমক, ‘এটা কি ঘুমোবার জায়গা? আর কদিন বাকি আছে রিটায়রমেন্টের? ছুটি দিয়ে দিচ্ছি একেবারে, বাড়ি গিয়ে রোজ ঘুমাতে পারবেন। যত্ত সব। আজকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যান।’

এঁরা কেউই জানতেন না, রতন টাটা অকৃতদার।

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s