এতদিন জানতাম পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়। ভেবে দেখলাম, একেবারে ভুল। ছাগল অনেক কিছুই খায় না, যেমন আমি কোনদিন ছাগলকে মাংস খেতে দেখি নি, ছাগলের মাংস তো আমরাই খাই। ছাগলকে পিজা বা বার্গার খেতে কেউ দেখেনি বলেই তো মনে হয়। পাগলও তেমনি যা খুশী কখনো বলে না। একটু কান দিয়ে আর মন দিয়ে শুনলে বোঝা যাবে, পাগলের ভিতর বাস করে এক একজন দার্শনিক। পাগল মন সাগরে ডুব দিয়ে হয় সমাহিত। তাই তাকে বুঝতে হলে চাই মন।ভাল করে ভাবলে দেখা যায়, পাগলরাই সংসারের চালিকা শক্তি।
পাগল কয় প্রকার ও কি কি? নিজেকেই প্রশ্ন করলাম।বুঝলাম পাগলের প্রকার হয় না, আকারেই তার প্রকাশ। পাগলের শিক্ষিত আশিক্ষিত প্রকার ভেদও করা যাবে না, কারণ সব পাগলেরাই শিক্ষিত। সবার আছে নিজস্ব স্পেসালাইজেসন, আলাদা আলাদা। পাগলের তাই জাত নেই, কুলও নেই।
মেয়েরা কেন যে পাগলে ভয় পায় কে জানে! আসলে বোধহয় তারা জানে একজন পাগল, না যায় দশটা পাঁচটার অফিসে, না যায় শপিং মলে আর বকা খেলে বেজায় ক্ষেপে যায়। আমার এক বান্ধবী, আমার কলেজ জীবনে, পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকবার আমার গায়ে উঠে পড়েছে পাগল দেখে। সেই থেকেই বোধ হয় আজও শেষ হল না আমার খাঁটি পাগলের সন্ধান।
“মনের মতো পাগল পেলাম না, আমি তাইতে পাগল হলাম না”
আমার কলেজ বেলায় এক কাকু আসতেন আমাদের বাড়িতে, জনার্দন কাকু। হাতে আনতেন চার – পাঁচটি বই। বসে বসে পড়তেন। তখন কথা বলতেন না। নিজের বাড়িতে বসে পড়ার কি আসুবিধা ছিল তা আর জিজ্ঞেস করে হয়ে ওঠা হয় নি। বইতে মুখ ডুবিয়েই হটাত একসময় বলে উঠতেন- ঘড়িতে কি দশটা বাজে, দ্যাখ তো। যেখানে বসতেন সে খানে কোন ঘড়ি ছিল না। অন্য ঘরে গিয়ে ঘড়িতে দেখতাম কাঁটায় কাঁটায় দশটা। অথচ জনার্দন কাকুর হাতে বাঁধা থাকত না কোন রিস্টওয়াচ। এরকম প্রায়শ হতে দেখে একদিন বললাম- কাকু তোমার কি বায়োলজিকাল ক্লক আছে? হাসলেন, কিছু বললেন না।
একদিন জনার্দন কাকু সকাল দশটায় এলেন। মুখে হাত চাপা, কোন কথা নেই। একঘণ্টা বসে থেকে উঠে পড়লেন। জিজ্ঞেস করলাম- কি হল কাকু, চললে না কি? কোন কথা নেই। দু দিন পর এসে বললেন-সেদিন কি হয়েছিল জানিস? কিছুই জানিনা, তাই মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বললেন- সেদিন দাঁত তুলে এসে ছিলাম সাইকেলের দোকান থেকে। আমি তো হতবাক। সাইকেলের দোকানে আমিও যাই, সে তো সাইকেল সারাতে। দাঁত ,সাইকেলের দোকান, সব গুলিয়ে যাচ্ছে। কাকু বললেন- একটা দাঁত নড়বড় করছিল। সাইকেলের দোকানের পচাকে বললাম- প্লাস দিয়ে হ্যাঁচকা টান দে। প্রথমে ভয় পেলেও ত্বিতীয় হ্যাঁচকায় দাঁত পটাং করে উঠে এল।
“ফকিরি করবি খ্যাপা কার লাগি………”
সে তখন তরুণ তুর্কী। দাড়িওয়ালা মুখে ঝকঝকে চোখ দুটো চোখে পড়ার মতো। সে তখন দিল্লী এসেছে সিভিল সার্ভিস দিয়ে ট্রেনিঙে। একরাত আমার বাড়িতে। আমার গিন্নী তখন কোলকাতা গেছেন আমাদের প্রথম সন্তানকে টেবিলস্থ করতে। কাজেই তারুন্যে ভরপুর সেই মানুষটি একরাতে আমার কাছে। বেজায় আড্ডা চলছে। তার লেখা ছড়া শুনছি। সে আচমকা জিজ্ঞাসা করল- দাদা, বাংলায় আনুবাদ করতো- চুরাকে দিল মেরা গোরিয়া চলে। গানটি তখন বাজারে খুব হিট। আমি পারব না বলাতে আনুবাদ করল নিজেই- চুরি করে আমার মন, মেয়েটা পালায়। রবীন্দ্র কবির প্যারডি “বাঘের কলে মোষ উঠেছে ধরল তিপে টুঁটি…।।” অসাধারন লাগল। এই আনুবাদের ধাক্কায় রাত ভোর হয়ে এল। সে এখনো ছড়া লেখে বাচ্চাদের জন্য আর তাদের জন্য বাজায় ঢাক, পৃথিবীকে সাদা আর কালোয় দেখবেনা বলে রামধনু রাঙানো চশমা পরে। তার দাড়িতে যেমন লেগেছে সাদা ছোপ, লেখার হাত হয়েছে আরও পক্ক।
“এ দিল, এ পাগ্ল, দিল মেরা………”
একসময় গভর্নমেন্ট আফিসে একটা পোস্ট ছিল – যাদের বলা হত কমপিউটার। তারা ছিল মানুষ কমপিউটার, যন্ত্র মানব নয়। ডাটা কমপিউট করতে হত। এমনই একজন মানুষ ছিলেন আমাদের আফিসে, পবন মাত্রে। খুব ব্রাইট। একদিন দেখলাম পবন আমাদের আফিসের সামনের ভরা রাস্তায় ট্রাফিক সামলাচ্ছে, মানে দুই হাত ট্রাফিক পুলিসের কায়দায় নাড়িয়ে চলেছে আর তাকে ঘিরে প্রবল যানজট। কয়েকজন দৌড়ে গেল পবনকে টেনে আনতে, ট্রাফিক পুলিসও এল দৌড়ে। কিছুদিন পর ওকে ক্যান্টিনে দেখা হতে যেই বারণ করলাম ওভাবে বিপদের ঝুঁকি নিতে, সে বলল- রোজ ইতনা ট্রাফিক, কিসিকো তো লেনা পড়েগা না রেস্পন্সিবিলিটি! আর একদিন দেখা হতে জিজ্ঞেস করল – মার্স মে পানি মিলা ক্যা? ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি দেখে বলল- আপকো কুছ ভি পতা নেহি, ক্যায়সা সাইন্টিস্ট হ্যায় আপ! ব্যাজার হয়ে বললাম – মিলেগা তো বাতাউঙ্গা। এরপর তার ট্রান্সফার হল অন্য অফিসে।
“ক্ষ্যাপা খোঁজে ফেরে পরশপাথর”
সমরেশ বসু থাকতেন নৈহাটি তে।ওখানেই কেটেছে আবার জীবনের প্রথম ভাগ। ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবী পরে থাকতেন। এটা জনার্দন কাকুর মুখে শোনা। উনি একটা গল্প লিখেছিলেন ভবা পাগলা কে নিয়ে। ভবার রাজত্ব ছিল মেয়েদের স্কুলের সামনের আধ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে। এক বাড়ির রোয়াকে শুয়ে থাকত সে।যে যা দিত, তাই খেত আর মাঝে মাঝে প্রানে ফুর্তি হলে হাত পা তুলে, দুলে দুলে, নাচত। গল্পটা খুব জনপ্রিয় হয়। সমরেশ বাবুর এক বন্ধু একদিন চুপিচুপি ভবাকে বলে দিল- ওই লোকটা তোকে নিয়ে বই লিখে আনেক টাকা পেয়েছে, ছাড়িস না। ব্যাস আর যায় কোথা, ভবা তক্কে তক্কে থেকে একদিন ধরল সমরেশ বাবুকে তার রাজত্বে। ভদ্রলোক বাজার যাচ্ছিলেন। ভবা প্রায় জড়িয়ে ধরে আর কি! – দে শালা টাকা দে। আমাকে নিয়ে বই লিখেছিস, বার কর শালা টাকা…।।। কি আর করেন, ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবীতে কাদা লাগার ভয়েই হোক, বা দয়া পরবশ হয়েই হোক, কিছু টাকা সেদিন ছাড়তেই হয়েছিল তাকে।
“ওরে মন পাগলে করল আমায় ঘরছাড়া……”
কাঁধে ছেঁড়া ঝোলা ব্যাগ, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, ময়লা ফুল প্যান্ট ফুল শার্ট, তিনি উঠে দাঁড়ালেন একটু উঁচু সিমেন্টের বেদীতে। চারিদিকে দোকান পাট, জে এন ইউ এর ছাত্র ছাত্রীরা, কল সেন্টারের তরুণ তরুণীরা। তিনি শুরু করলেন তৃতীয় বিশ্ব নিয়ে তার বক্তৃতা। যারা নতুন, তারা দাঁড়িয়ে গেল, যারা গত বিশ বছর ধরে শুনছেন ও দেখছেন, তারা নিঃস্পৃহ চোখে তাকিয়ে দেখে চলে গেল যার যার কাজে।টানা দশ মিনিট না থেমে ইংরাজি ও হিন্দীতে তার বক্তৃতা শেষ করলেন। নেমে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কেমন আছি, কেননা কুড়ি বছরের জানাশোনা। কথা হয় না খুব একটা, কিন্তু ওনার লেখা তৃতীয় বিশ্ব সংক্রান্ত পোস্টার নিয়মিত পড়ি এটা উনি জানেন। শুনেছি জে এন ইউ তে গবেষণা করতেন এক সময়। ষড়যন্ত্রের শিকার হন, কেউ পুরো থিসিসটা টুকে মেরে দিয়ে ডক্টরেট করে। দু বার উনি সিভিল সার্ভিস মেইন্স উত্তীর্ণ হয়েও ইন্টার্ভিউ তে আটকে যান। আজ ফুটপাত আস্তানা। রম রম করে যে কাফেটা চলছে ওখানে, তারাই ওকে খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। ভাল থাকলে ছাত্র ছাত্রীদের থিসিস লিখে দু পয়সা পান। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে আর ফিরে যান নি। আমাকে বললেন উনি প্রতি শনিবার বট গাছ তলায় সন্ধ্যে ছটায় নারী সুরক্ষা নিয়ে আলোচনার আসর বসান। আমন্ত্রণ থাকলেও আজ পর্যন্ত যাওয়া হয় নি।
মনের মতো পাগল পেলাম না, আমি তাইতে পাগল হলাম না।