অ-এ অর্বাচীন

আমি একটি পাঠাগারে যাই প্রতি রোববার। আসলে কি জানি ছোটবেলা থেকেই পাঠাগার ব্যবহার করে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। কিশোর জীবনে পয়সা দিয়ে বই কিনতে পারার অক্ষমতাও অন্যতম কারণ ছিল। দিল্লীর বুকে বাংলা বইয়ের পাঠাগারগুলো বইয়ে ঠাসা হলেও পাঠকের অভাবে ধুঁকছে। তাই সে পাঠাগারে যে চার পাঁচটি পাঠক আছেন তার মধ্যে এই অধমও আছে।

রোববার সকাল। গিয়ে দেখি সব পাঠকই উপস্থিত। নরক গুলজার। চায়ের কাপে টাইফুন। পেট থেকে পড়েই আড্ডাবাজ। বসে পড়লাম জমিয়ে। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক টাইপ করা কাগজ থেকে নিজের ইংরেজিতে লেখা রম্য রচনা শোনাচ্ছেন। আমি ইংরেজি সিনেমা দেখে তার ডায়লগ থেকে ‘ইয়া’ শব্দটি ছাড়া জীবনে এযাবৎ অন্য শব্দের একবর্ণও বুঝতে পারিনি। তাই বললাম ‘একটু পড়ে দেখি?’।

তিনি কাগজটি পকেটস্থ করে বললেন,’ছাপা না হওয়া পর্যন্ত আমি নিজের লেখা কাউকে দেখাই না।

পাশ থেকে বন্ধু আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘দাদা, এও একটু আধটু লেখা টেখা…’।

অধ্যাপক আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোন কোন পত্রিকায় লেখেন?’ আমি জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলি, ‘ওই… ওয়েব ম্যাগ অবধি দৌড় আর কি… ছাপা পত্রিকাতেও দু একটা…’।

আমার মুখের কথা না ফুরতেই ওনার মুখে ফুটল, ‘অ, তো সে ওয়েব ম্যাগটি কি জিনিস?’

বললাম। শুনে বললেন, ‘অ’।

আবার প্রশ্ন করেন, ‘গল্প না প্রবন্ধ?’

বলি, ‘গল্প, প্রবন্ধ, যখন যেটা মনে আসে…’।

জ্ঞানী বৃদ্ধটি বললেন, ‘অ’।

পাশ থেকে আর এক পাঠক, ‘দাদা, ও বাঙলায় লেখে…’।

উনি হতাশ হয়ে, ‘অ, বাঙলা!’

তারপর আবার প্রশ্ন, ‘ওই ম্যাগ না কি বললেন, ওগুলো কেউ পড়ে?’

আমি অজ্ঞানী। বলে বসি, ‘জানিনা, আমি তো পড়ি, অন্য কেউ…’।

আবার উত্তর এলো, ‘অ’।

এতদিন অ-এ অজগর জানতাম। আজ বুঝলাম, অ-এ অর্বাচীন। কারণ অ-এ অরূপও।

একটা বাঙলা বই কাঁধের ঝোলায় সম্বল করে, আমি অর্বাচীন, ডেরায় ফিরলাম।

বাঙালির বাংরেজি

বাংলায় ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন হয়েছিল বলেই বোধহয় ইংরেজি ভাষার প্রতি বাঙালির একটু দুর্বলতা আছে। কিন্তু সেই দুর্বলতা, তাকে কখন যে দুর্বল করে দেয়, সে নিজেও জানে না। তবু কথার মাঝে দুচারটে ইংরেজি বুলি গুঁজে দিতে না পারলে, নিজেকে কেমন যেন সাধারণ মাপের বলে মনে হয়। শিক্ষিত বাঙালির মুখের ভাষা তাই ইংরেজি। বাংরেজির বানে ভেসে যেতে যেতে টেরই পাওয়া যায় না, কখন সব উজাড় হয়ে গেছে।

জীবনের প্রথম চাকরিটি পাই এক সওদাগরি অফিসে। আমার বসটি ছিলেন দখিনি। তিনি তখন সদ্য কোলকাতায় ট্রান্সফার পেয়ে এসেছেন। বাংলা শব্দের মধ্যে ‘ভালো’ ছাড়া অন্য শব্দ বলতে শিখে উঠতে পারেননি। সেই ‘ভাল’ শব্দটা আবার অনেকটা শোনাত – ‘বালো’। কাজেই প্রথম দিন, প্রথম দর্শন থেকেই, ‘মে আই কাম ইন’ দিয়ে শুরু হল চাকুরি জীবন। মনে মনে বাংলা বাক্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে টেবিলের অপর প্রান্তে ছুঁড়ে দিতে থাকলাম। আমাকে থামিয়ে দিয়ে, মাঝে মাঝে তিনি বলে ওঠেন, “হোয়াট?”, “রিপিট”, “পার্ডন”, ইত্যাদি। সীমিত গুটিকতক ইংরেজি শব্দ সম্বল করে, সকাল বিকেল তাকে মনে মনে প্রচুর গালাগালি করে, ‘পার্ডন’ করা আর হয়ে উঠল না। বুঝলাম মফস্বলের বাংলা মিডিয়াম ইশকুলে আর যাই হোক, মুখে মুখে ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ করা শিখে ওঠা যায়নি, আর হলেও অপরপক্ষকে বোঝাতে ঘাম ছোটে।

কিছুদিন পর একটু ভরসা হল, যখন আমাদের অফিসের একাউন্টেন্টকে সাহেবকে চেম্বারে বসে টেলিফোনে শুধু মাত্র “নো নো নো নো নো নো…ইয়েস ইয়েস ইয়েস ইয়েস…” দিয়ে কাজ চালাতে দেখলাম।

চৌরঙ্গী সিনেমার কথা মনেপড়ে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। উত্তমকুমার, স্যাটা বোস শুভেন্দুকে বলছেন – যখন হোটেলে চাকরি করতে এসেছিলাম, তখন হোটেলওয়ালারা সেক্সপিয়ারের মত ইংরেজি, রবীন্দ্রনাথের মত বাংলা, আর তুলসী দাসের মত হিন্দি তার কাছে আশা করেছিল। কিন্তু আমি সেক্সপিয়ারের মত বাংলা, রবীন্দ্রনাথের মত হিন্দি, আর তুলসীদাসের মত ইংরেজি দিয়ে কাজ চালাতে লাগলাম।

তাই নিজের তুলসীদাস তুল্য ইংরেজি মুনশিয়ানা নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম।

বছর দুয়েক সওদাগরি অফিসে কাজ করে চললাম দিল্লির মসনদে। তখন সরকারি মসনদ ছিল লৌহ নির্মিত প্লাস্টিকের বেতের চেয়ার, ঘূর্ণায়মান চক্রবাহিত কুশনাবৃত চেয়ার তখনো চালু হয়নি। দ্বিতীয়োক্ত চেয়ারে বসা মাত্র ইংরেজির বানভাসি হতে দেখেছি চাকরির পরবর্তী পর্যায়ে। প্রথমোক্ত চেয়ারে বসে ইংরেজিতে কথা বলা আয়ত্ব করা বেশ কষ্টকর হল। সে যাই হোক কাজ চলতেই থাকল। বাংলার বেশ কিছু বাঘ ও বাঘিনী তখন দিল্লিতে রাজনীতির শক্তি-অলিন্দে দাপট করে বেড়াচ্ছিল। কোনও এক সভায় এমনই এক বাংলার বাঘিনীকে (তিনি তখন কংগ্রেসর খেল মন্ত্রী) দেখলাম হিন্দি-ইংরেজি-বাংলার খিচুড়ি বানিয়ে সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে পরিবেষণ করছেন। আবার ভরসা হল নিজের উপর। ছোটবেলায় পড়া গল্প মনে পড়ে গেল। এক কেরানী ইংরেজ ঊর্ধ্বতনকে উদ্দেশ্য করে বেতন বাড়ানোর দরখাস্তে ইংরেজিতে লিখল – “মাই ফ্যামিলি, স্মল ফ্যামিলি, ডেইলি টুয়েন্টি লিভ্‌স ফল, লিট্‌ল লিট্‌ল পে, হাউ ম্যানেজ!”

তা আমার যে ইংরেজি কথ্য ভাষাতেই সমস্যা সেদিন বুঝলাম, যেদিন আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারটি আমাকে জানালেন, “বেঙ্গলীস আর ভেরি গুড ইন ইংলিশ, বাট হোয়েন দে স্পিক – ইট সিম্‌স, দে হ্যাভ রসগুল্লাস ইন দেয়ার মাউথ।”

ধীরে ধীরে বুঝলাম, শুধু বাঙালি নয়, ‘বাংরেজি’ জাতীয় সমস্যা সব প্রদেশের লোকেরই আছে, খামোকা ভেবে মরি আমরা বাঙালিরা। গুরুত্বপূর্ণ মিটিঙে এমনই পাঞ্জাব পুত্তরকে দেখেছি – গলার শির ফুলিয়ে, দাঁত ভেঙে – বৃথা চেষ্টা করে চলেছে আংরেজির তৃষ্ণা মিটাবারে। তার ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখে আমার বঙ্গ হৃদয় বলে উঠেছিল – “মাতৃভাষা রুপখনি, পূর্ণমনিজালে…।”

তা সবে অবোধ সেই পাঞ্জাবি পুত্তর হাল ছাড়েনি, বেহাল হলেও। বেচারা জানতেও পারেনি, অমন ইংরেজির চাইতে পঞ্চনদের ভাষা অনেক বেশি সহজবোধ্য হত আমাদের।

আমার বাংরেজির আর এক পরীক্ষার দিন এল আরও ক’বছর পর। আমাদের গৃহ সহায়িকা তার দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার আগে নিজের বিকল্পে একটি দক্ষিণী কন্যাকে দিয়ে গেলেন আমাদের সহায়তার জন্য।

গিন্নি তার স্কুলে গেছেন, আমি ঘর সামলাচ্ছি। গৃহকর্ম সহায়িকা দেখি ইশারায় কী যেন বলে চলেছেন। বুঝলাম, তিনি মূক বা বধির, অথবা দুইই। আমিও ইশারায়…কিন্তু একে গিন্নি বাড়ি নেই, আমি একা, কন্যার বয়স সুবিধাজনক নয় – এই সব ভেবে ইশারায় কাজ চালানো খুব সঙ্গিন মনে হল না।

অফিস থেকে ফিরে গিন্নিকে বললাম, “কোথা থেকে কাজের লোক জোগাড় কর কে জানে? মেয়েটা তো বোবা!”
গিন্নি হেসেই খুন, “আরে ও সবে চেন্নাই থেকে এসেছে, এখনো হিন্দি শেখেনি। তবে ইংরেজিটা দারুণ বলে।”
গৃহ সহায়িকা ইংরেজিতে কথা বলছে, ভাবা যায়? আচ্ছা, ভাবা যাবে নাই বা কেন? লন্ডন আমেরিকায় সহায়কেরা ইংরেজিতেই তো কথা বলে!

পরদিন দখিনী কন্যে কাজে এলেন। এসেই আমাকে ইশারায় যা বলতে চাইলেন, তার মানে হচ্ছে – ঝাঁটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ধুর ছাই, ঝাঁটার ইংরেজি যেন কী…মনে পড়েছে, ‘ব্রুম’। খাটের তলা থেকে ঝাঁটা বার করে বলি, “হিয়ার ইস দ্য ব্রুম।”
এবার তিনি ঘর মুছবেন। ন্যাতার ইংরেজি যেন কী…মনের তলায় সাবমেরিন নামিয়ে বার করে আনলাম, ‘মপ’। ভয়ে ভয়ে বলি, “হিয়ার ইস দ্য মপ ম্যাম…”। আঙুল কামড়াই – করেছি কী? কাজের মেয়েকে কেউ ম্যাম বলে। কী জানি, বিদেশেও বলে বোধহয়।
ও বুঝতে পেরে বলে, “বি কমফোর্টেবল স্যার। আই উইল ম্যানেজ।”

এইভাবে আমাদের বাংরেজি ও কন্যের ইংরেজি দিয়ে ঘরের কাজ চলতে থাকে। হপ্তা দুয়েক ইংরেজি বলা সহায়িকা বিকল্পে কাজ করেছিল। নিয়মিত সহায়িকা ফিরে এলে একদিন তাকে আমরা সবাই ভুলে গেলাম। শোনা যায়, মেয়েটি নাকি পড়াশুনোয় ভাল ছিল। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লোকের বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ নিতে হয়। বড় ব্যথা পেয়েছিলাম।

আমার বাংরেজি নিয়েও ট্যাক্স পেয়ারের পয়সায় আমি দিব্যি করে কম্মে খাচ্ছি, আর ভাল ইংরেজি বলেও মেয়েটিকে পরের বাড়ি বাসন মেজে পেট চালাতে হয়। ঠিকানা জানা না থাকায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাজধানীর বিপুল জন সংখ্যার ভিড়ে সে হারিয়ে গিয়েছিল।

হেরে গেলেন হারুদা

হারুদা গতমাসে রিট্যায়ার করলেন। হারুদা নামে হারু হলেও হারতে শেখেন নি কোনোদিন। চিরকাল শেষ বাজিটা চিত করে দিয়ে উনিই জয়ের হাসি হেসেছেন। ছিলেন সরকারি আমলা। বেশ হোমরা চোমড়া গোছের। বাঘে গরুতে একসাথে জল খাওয়া অনেকদিন শেষ। স্বাধীনতার সত্তর বছর কেটে গেছে, তাই আমলাদের প্রতিপত্তি একটু ঘাটতির দিকে। কিন্তু হারুদা নিজেকে সরকারি যন্ত্রের এক অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ বলে মনে করতেন। যন্ত্রাংশের মন থাকতে নেই। যন্ত্রপরিচালকের হাতে যেমন যন্ত্র চালিত হয়, তেমনি যন্ত্রাংশ চালিত হয় যন্ত্রের ইচ্ছেয়। তাই সরকারি যন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ হয়ে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে গলায় গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে রিট্যায়ার করলেন হারুদা।

হারুদার পোশাকি নাম শ্রী হারীন্দ্র লাল গুঁই। আড়ালে তাকে অধস্তনরা হালাগু বলে ডাকত। মঙ্গোল বংশধর অত্যাচারী হালাগু খানের সাথে হারুদার আদেশে ও আচরণের কিছু কিছু মিল হয়ত থেকে থাকতে পারে।

গুরুপদে আসীন এই মানুষটি দম ফেলবার সময় পেতেন না। বাড়িতে একদণ্ড সময় দিতে পারতেন না। তাকে বাড়িতে দেখলেও মনে হতো যেন তিনি অফিসে বিরাজমান। মুখ তুলে আকাশ দেখার সময় পাননি, ঘাড় গুঁজে চিরকাল কাজ করে গেছেন। বিয়ের পর প্রথম দু চার সপ্তাহ বাদ দিয়ে সদা ব্যাতিব্যস্ত স্বল্পভাষী কর্ম পাগল মানুষ। তবে এই দীর্ঘ কর্মজীবনে কখন যে দুটি ছেলে মেয়ে হয়েছে, তারা পড়াশুনো করে মানুষের মতো মানুষ হয়েছে, হারুদার মনে নেই, থাকবার কথাও নয়। তিনি যে অতি দরকারি, এক সরকারি আমলা!

রিট্যায়ার করবার আগের দিন সহকর্মীরা জানায়, বউকে ফেয়ারওয়েলের দিন নিয়ে আসা নাকি প্রোটোকলের মধ্যে পড়ে। প্রোটকল বলে কথা। সরকারি আমলা প্রোটোকলে জব্দ। হারুদা বউকে বলে রাখলেন আগে ভাগে। এদিকে কতদিন একসাথে কোথাও বাইরে বেরিয়েছেন মনেও পড়েনা। বরের রিট্যারামেন্টের কথা মনে ছিল ঠিকই হারু বউদির। তবে তিনি সাংসারিক নানাবিধ কাজে ব্যাপারটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারেন নি। তেমন করে তিনি আর মানুষটার সঙ্গ পেলেন কই! শনি রবিবার হলেও তকমা এঁটে হারুদা চলত অফিসে। একবারও এল টি সি না নিয়ে রেকর্ড করে সরকারের কত টাকা বাচিয়ে দিয়েছে সে নিয়ে সহকর্মীদের কাছে গর্ব করেছে হারুদা। বউদিও কোনোদিন অনুযোগ করেন নি। অনুযোগ অভিযোগ শোনবার মতো সময় কোথায় ছিল হারুদার? সারাজীবন ধরে শুধু ছুট আর ছুট!

গাঁদা ফুলের মালা বুকে ঝুলিয়ে, ঢাউস সুটকেস উপহার নিয়ে, বউয়ের পাশে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ফটো তুলে (হারুদাকে কেউ কোনোদিন হাসতে দেখেনি অফিসে), অফিসের গাড়িতে শেষ বারের মতো চড়ে, বাড়ি ফিরে এলেন হারুদা। মন উদাস। হবারই কথা। তেত্রিশ বছরের কর্মব্যস্ত জীবন। ফেরার সময় বউদিকে আদালতে রায় শোনাবার মতো করে জানালেন, “কাল থেকে আর অফিস নয়। শুধু তুমি আর আমি। দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে গেলাম বুঝলে।“ বউদির নীরব। জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে চলমান রাস্তা দেখতে থাকলেন।

পরদিন সকালবেলা। মুক্তির প্রথম দিন। হারুদার জীবনে তাড়া নেই। সব তাড়াহুড়ো আজ থেকে শেষ। অন্তত হারুদা তেমনটাই ভাবলেন। বালিশে মুখ গুঁজে, ঘাপটি মেরে পড়ে  আছেন। অভ্যেস যাবে কোথায়? সকাল ছটায় নিয়মমাফিক ওঠার অভ্যেস তো আর একদিনে যাবার নয়। বসার ঘর থেকে মিউজিক সিস্টেমে গান ভেসে আসছে – “তোমায় নতুন করে পাবো বলে, হারাই ক্ষনে ক্ষন, আমার ভালবাসার ধন, তোমায় নতুন করে পাবো বলে……।“

গানের ফল হল, হারুদা আচমকা প্রেম জ্বরে আক্রান্ত হলেন, জীবনে বোধহয় প্রথম। বউদি কি কাজে ঘরে এসেছিলেন কে জানে, হারুদা তার হাত ধরে মারলেন এক পেল্লায় টান। বউদি চমকে উঠলেন, কিন্তু সাময়িক। গোমড়া মুখে ঘর গোছাতে লাগলেন।

হারুদা বললেন, “এবার তুমি আর আমি…।“

  • কি তুমি আর আমি?
  • এবার শুধু ঘুরে বেড়াবো। তুমি আর আমি। আহা, মুক্তি…শান্তি, আহা।
  • হ্যাঁ আমারও মুক্তি। অফিসের ভাত বাড়তে হবেনা। রাতে তোমার ফিরতে দেরী হলে ঠাণ্ডা খাবার নিয়ে বসে থাকতে হবেনা…।
  • ঠিক, বড্ড জ্বালিয়েছি গো তোমাকে…এবার থেকে আর না।

হারুদার মুখে যেন আজ কথার খই ফুটেছে। বউদির প্রতি প্রেম উথলে উঠেছে।

  • এই গানটা কি আমার জন্য চালিয়েছ আজ?
  • কোন গানটা?
  • ওই যে, তোমায় নতুন করে পাবো বলে…আজ আমিও যেন কেমন তোমায় নতুন করে পাচ্ছি জানো?
  • ধুর, তোমার জন্য চালাবো কেন? আমি তো রোজই এ সময় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি চালিয়ে কাজ কম্ম করি। এ আর নতুন কি? বাড়ি থাকলে তো জানতে পারতে।

বউদির ধারালো জবাবে হারুদা কুপোকাত। বেজার মুখে বলে, “চলো না কোথাও ঘুরে আসি!”

  • যাব, ছেলেমেয়ে দুটো দুজনেই বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে আছে অনেকদিন হল। কালই তিন্নি ফ্লাইটের টিকিট পাঠিয়েছে মেইলে। আমি সামনের সপ্তাহে তিন্নি আর গাব্বুর কাছে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে যাব। আর হ্যাঁ, ওরা শুধু আমার টিকিট পাঠিয়েছে। লিখেছে, বাবা ব্যস্ত থাকে, ছুটি পাবেনা…।
  • সেকি, আমি একা একা এখানে…।
  • তুমি আমায় এবার মুক্তি দাও। স্বাধীন হয়ে নিজের মতো জীবনটা কাটিয়ে দেখি না কদিন। আর তোমার পোস্ট রিটায়ারমেন্ট এস্যাইনমেন্টের কি হল?

কিছুক্ষণ নিরব থেকে হারুদা সরব হলেন, ‘ভাবছিলাম নেবো না। আমিও কিন্তু ভেবেছিলাম – তোমায় নতুন করে পাবো…।“

বউদি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘আমিও ভেবেছিলাম গো, ছাব্বিশ বছর আগে। তুমি বরং এনজীও খুলে ফেল। দেখ, নতুন করে কাউকে পাও কিনা।

নির্ভরযোগ্য সুত্রের খবর, হারুদা এখন বিনোদিনী মায়ের আশ্রমে পাকাপাকি ঠাই নিয়েছে। নতুন করে কাউকে পেয়েছেন কিনা এখনো জানা যায়নি। আর বউদি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় দুই ছেলে মেয়ের সাথে দিব্যি জীবন কাটাচ্ছেন। খুব শিগগির আসবেন বলে মনে হয়না।

বিতর্কিত জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে

 

জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি একটি বহুল চর্চিত নাম। পৃথিবী যে সূর্যের চারিদিকে ঘোরে, সে কথা প্রমাণ করার চেষ্টা তিনিই সর্ব প্রথম করেন। তখন মানুষ মনে করত পৃথিবী এক স্থানে স্থির আর মহা প্রতাপশালী সূর্য তার চারিদিকে পাক খাচ্ছে। চার্চও সে কথাই প্রচার করত।

পোপের বিরুদ্ধে মতামত দিয়ে গ্যালিলিওকে অপিরিসীম কষ্টও স্বীকার করতে হয়। এ সব কথাই আমাদের অল্পবিস্তর জানা আছে। কিন্তু গ্যালিলিওর পূর্বসূরি টাইকো ব্রাহে কোনও অংশে কম ছিলেন না।  জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের জন্ম হয় ডেনমার্কে ১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। ডেনমার্কে সেই সময় দুই ধরনের মানুষ ছিল। এক শ্রেণী রাজার পৃষ্ঠ পোষক, কাজেই তারা ছিল ধনী, আর এক শ্রেণী ছিল অত্যন্ত গরীব। টাইকো ছিলেন প্রথম শ্রেণীর। টাইকো তার ধনী বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। তাঁর কাকা জোরগেন ব্রাহের কোনও সন্তান না হওয়ায় টাইকোকে তিনি দত্তক নিতে চান। টাইকোর বাবা-মা সে প্রস্তাবে সম্মতি দেননা। জোরগেন ছিলেন ডেনমার্কের রাজার সামরিক বাহিনীর এক প্রথম সারির সেনাপ্রধান। তিনি বেজায় চটে গিয়ে টাইকোকে অপহরণ করেন। টাইকোর একটি ভাই জন্মালে, ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে যায়। টাইকো তাঁর কাকার কাছে মানুষ হতে থাকেন। একসময় কাকার বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তাধিকার হলেন টাইকো।

কাকা জোরগেনের ইচ্ছানুযায়ী টাইকোর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় আইন বিষয় নিয়ে। যদি তিনি আইনের পথে হাঁটতেন তাহলে এক অসামান্য জ্যোতির্বিদের বিচিত্র আবিষ্কার থেকে বিজ্ঞান বঞ্চিত হতো। কিন্তু সহসা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে গেলো। তার বয়স যখন চোদ্দ, তখন তিনি সূর্য গ্রহণ দেখে অত্যন্ত বিস্মিত হন। স্থির করেন গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি জানবার কাজেই আত্মনিয়োগ করবেন। আর যেমন ভাবা তেমনই কাজ। একটু বড় হয়ে আইন বিষয়ে পড়তে গেলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাথায় ওদিকে ঘুরে চলেছে গ্রহ নক্ষত্রের বিচিত্র জগত নিয়ে বিস্ময়ের পোকা। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর মুল্যবান সব বই কিনে ফেললেন। টলেমী আর কোপার্নিকাসের কাজ তন্ন তন্ন করে পড়ে ফেললেন। কিছু গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ যন্ত্রও কিনে ফেললেন। লেগে পড়লেন পুরনো মানযন্ত্রগুলো নিজের মতো করে গড়ে তোলার কাজে। সাথে চলল অঙ্ক কষে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা। আইন আর কলা বিষয়ে পড়াশুনোও করতে হচ্ছে তখন। নিজের পরিবর্তিত মানযন্ত্র গুলো সবার চোখের আড়ালে রেখে দিয়ে রাত জেগে গ্রহ নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ হল তাঁর শখ।

টাইকোর কাকা, সেনাপ্রধান জোরগেন ব্রাহে, রাজা ফ্রেড্রিক-২ এর পরম বন্ধু ছিলেন। একবার জাহাজে রাজার সাথে ভ্রমণের সময় রাজাকে সমুদ্রে পড়ে যাবার থেকে বাঁচিয়ে দেন জোরগেন। কৃতজ্ঞতা হিসাবে জোরগেনকে আস্ত একটা দ্বীপই উপহার দিয়ে দেন রাজা।  সুইডেন আর ডেনমার্কের মাঝে অবস্থিত সেই দ্বীপের নাম ছিল হ্যাভেন। জোরগেন মারা যাবার পর টাইকো ব্রাহে হ্যাভেন দ্বীপে ইউনানিবর্গ প্রাসাদ গড়ে তোলেন।

বিবিধ মানযন্ত্র বানিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণে অত্মনিয়োগ করলেন সম্পূর্ণভাবে। এই সময় তার তৈরি উল্লেখযোগ্য তিনটি যন্ত্র হল- দ্বিগংশিক বলয় (Azimuthal Quadrant), ভূগোলক (Celestial Sphere)  এবং আরমিলারি গোলক (Armillary Sphere).  দ্বিগংশিক বলয় ব্যবহার করে ধূমকেতুর গতিপথ নির্ণয় করা হয়েছিল। ভূগোলক, মহাকাশে নক্ষত্র সমূহের আবস্থান চিহ্নিত করার জন্য নির্মাণ করা হয়। আরমিলারি গোলকের সাহায্যে গ্রহনক্ষত্রের অক্ষাংশ- দ্রাঘিমাংশ সুনিশ্চিত করা হয়েছিল। ডেনমার্কের রাজা ফ্রেড্রিক ২ ব্রাহের বৈজ্ঞানিক মেধা এবং কাজে খুশি হয়ে তার কাজের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।

একবার বেশ মজার এক কাণ্ড ঘটে। টাইকোর বয়স তখন বছর কুড়ি। অঙ্কের এক জটিল ফর্মুলা নিয়ে তার সাথে তর্ক বাধে আর এক জ্যোতির্বিদের। কেউ কারো চাইতে কম যায় না। তাই দুজনে ঠিক করেন ডুয়েল লড়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। দেখাই যাক, কে ঠিক আর কেই বা বেঠিক। ডুয়েল লড়তে গিয়ে টাইকোর লম্বা নাক গেল উড়ে।  তারপর থেকে উনি তামা, সোনা আর রুপোর তৈরি তিনটি নাক তৈরি করেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই নাক পরে পার্টিতে জেতেন।

সাধে কি আর বলে, বিজ্ঞানীরা একটু ছিটিয়াল হয়! আবার ছিটিয়াল না হলে কে টাইকোর মতো প্রায় ১০০০ নক্ষত্রের এক মহামূল্যবান তথ্য ভাণ্ডার দিয়ে যেতে পারত মানব জাতির জন্য? টাইকো তার তথ্যাবলী আজীবন কাউকে হাত লাগাতে দেননি। কেবল মারা যাওয়ার মাত্র একবছর আগে জ্যোতির্বিদ জোহান্স কেপলারকে তার সহায়ক নিযুক্ত করেন। কেপলার তার মেধার মাধ্যমে টাইকোর মন জয় করে নিতে পেরেছিলেন। টাইকো মারা যাবার পর, টাইকোর সৃষ্ট পাণ্ডুলিপি কেপলারের হাতে আসে। আর তিনিও পরবর্তীকালে পৃথিবী বিখ্যাত হন।

এবার দেখা যাক টাইকোর বর্ণীত সৌরজগত কেমন ছিল। টাইকোর কাজ নিয়ে ভাবনা চিন্তা  করার আগে মাথায় রাখার দরকার যে সে সময়ে টেলিস্কোপ আবিষ্কার হয় নি। টেলিস্কোপ তৈরি করার কথা ভাবেন নি টাইকো। প্রথম টেলিস্কোপ তৈরি হয় গ্যালিলিওর হাতে, আরও কিছু বছর কেটে যাবার পর। টাইকোর প্রস্তাবিত সৌরজগতের কেন্দ্রে ছিল পৃথিবী। সূর্য পৃথিবীর চারদিকে পাক খায় বৃত্তাকারে। গ্রহেরা সূর্যেকে প্রদক্ষিণ করে বৃত্তাকার পথেই। টাইকোর সৌরজগতের মডেলে একটাই ভুল ছিল। সেটা হচ্ছে পৃথিবীও যে অন্য একটি সৌরগ্রহ, তা অস্বীকার করা। হয়তো তৎকালীন প্রচলিত চার্চ স্বীকৃত ধারনার বিপক্ষে যাওয়া টাইকোর পক্ষেও সম্ভব হয় নি।  টাইকোর পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে যে চাঁদ পৃথিবীকে চক্রাকারে পরিক্রমা করে চলেছে। কিন্তু চাঁদকেও একটি গ্রহ হিসাবে ধরা হয়। টাইকো ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটোকে খুঁজে পান নি। তাই চাঁদ ও সূর্য সমেত মোট আটটি গ্রহকে স্বীকৃতি দেন। তিনি তার অক্লান্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মঙ্গল (Mars)  গ্রহের গতিপথের উপর এক সুবিশাল পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেন। সেই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে কেপলার তার গ্রহের গতিপথের তিনটি বিখ্যাত সূত্র আবিষ্কার করেন। 

টাইকোর দ্বিতীয় প্রধান কাজ ধূমকেতু নিয়ে। এরিস্টটলের সময় থেকেই মনে করা হত ধূমকেতু পৃথিবী বা চাঁদ থেকে নির্গত কোনও গ্যাসের প্রভাব। প্রচুর পর্যবেক্ষণ করে, অঙ্ক কষে, টাইকো জানান, ধূমকেতু চাঁদের থেকে অনেক দূরে। আর এটা মোটেই পৃথিবী বা চাঁদের কোনও অংশ নয়। ধূমকেতু বস্তুত বরফ আর পাথরের জমাট মিশ্রণ। সূর্যের তাপে তা থেকে গ্যাসের উদ্ভব হয়ে থাকে।     

১৫৭২ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর খুব কাছে, এক আশ্চর্য আলোর ছটা সারা আকাশ জুড়ে দেখা যায় অনেকদিন যাবত। এই ঘটনার পিছনে দৈব শক্তির হাত আছে বলে ভাবা হয়। টাইকো তার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান আর যুক্তি দিয়ে প্রমান করেন যে আলোর ছটার পিছনে আছে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি এসে পড়া একটি মৃত্যু পথযাত্রী নক্ষত্র। আধুনিক বিজ্ঞান এই ঘটনাকে সুপারনোভা বিস্ফোরণ বলে জানে।

টাইকো ব্রাহের আগে পর্যন্ত এরিস্টটলিয় ধারনা ছিল, স্বর্গ অর্থাৎ আকাশ, অপরিবর্তনীয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তার অবদান প্রচলিত ধ্যান ধারনাকে আমূল বদলে দিতে শুরু করে, যার প্রভাব কেপলার বা তার উত্তরসূরিদের অগ্রসর হতে সাহায্য করে।

টাইকো ব্রাহের খ্যাপামি নিয়ে আনেক গল্প শোনা যায়। তার প্রাসাদে তিনি এক বেঁটে মানুষকে নিজের সহচর হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। এমন বিশ্বাস করতেন যে সে যাদুবিদ্যার অধিকারী। তার আর এক সহচর ছিল বাঁকানো শিং ওয়ালা এক জংলী হরিণ। ব্যস্ততার জন্য টাইকো একবার এক নেমন্তন্ন বাড়িতে যেতে না পারায়, সহচর হরিণটিকে নেমন্তন্ন রক্ষা করার জন্য পাঠিয়ে দেন। সেই নেমন্তন্ন বাড়ির ভোজের সাথে পানীয় কিছু বেশি পরিমানে খেয়ে ফেলে হরিণটি ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

জীবনের শেষ পর্যায়ে টাইকো ব্রাহেকে ষড়যন্ত্রের স্বীকার হতে হয়। সাধাসিধা এক বিজ্ঞান সাধকের জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। ব্রাহের অমানুষিক পরিশ্রমসাধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের মুল্যবান তথ্য চুরি করে প্রাগে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রাগে সেই সময় এ্যডলফ-২ রাজত্ব করতেন। তিনি প্রবল গুণ সম্পন্ন হলেও একটু খ্যাপাটে স্বভাবের ছিলেন। জ্যোতিষ বিদ্যা ও যাদুবিদ্যায় তার বিশেষ আগ্রহ থাকায় ব্রাহের উপর তার নজর পড়ে।

ব্রাহের মৃত্যুও কিছু কম চমকপ্রদ নয়! জানা যায় নেমন্তন্ন বাড়িতে বেশি পরিমাণ বিয়ার খেয়ে ফেলেন তিনি। কিন্তু কিডনির সমস্যার জন্য প্রস্রাব আটকে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে বিছানা নেন। এর কিছুদিন পর ১৬০১ সালে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন যে তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হন ও মার্কারি বিষ প্রয়োগে তাকে মেরে ফেলা হয়। সন্দেহের প্রথম তালিকায় ছিলেন তার প্রধান সহায়ক জোহান্স কেপলার। টাইকো ব্রাহে যাকে বিয়ে করেন, তিনি ছিলেন সাধারণ ঘরের। যেহেতু ব্রাহের জন্ম হয় অভিজাত পরিবারে,  ডেনমার্কের সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী ব্রাহের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানদের তার সম্পত্তিতে অধিকার ছিলনা। সেই সুযোগে কেপলার ব্রাহের সমস্ত সম্পত্তি এবং বৈজ্ঞানিক দলিলের মালিকানা পেয়ে যান। সে কথা কেপলার নিজে স্বীকারও করেন। কেপলারের প্রতি অভিযোগের আঙুল ওঠে। অন্য এক মতে তদানীন্তন ডেনমার্কের রাজা খ্রিস্টিয়ান-৪, ব্রাহের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বিষ প্রয়োগে মেরে ফেলবার জন্য ব্রাহের দুঃসম্পর্কের এক ভাইকে নিযুক্ত করেন। কারো কারো মতে সেক্সপিয়ার তার হ্যামলেট নাটকের নাট্য উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন ব্রাহের মৃত্যু রহস্য ঘিরে।

ব্রাহের মৃত্যু রহস্য নিয়ে ডেনমার্ক তোলপাড় হলে ১৯০১ সালে কবর থেকে তার দেহ উদ্ধার করে সুইডেন এবং ডেনমার্কে ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়। ব্রাহের গোঁফ ও চুল  পরীক্ষার ফলাফল বিষ প্রয়োগের অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত করে। ফরেনসিক পরীক্ষায় অনেকেই সন্তুষ্ট হননি। তাই ব্রাহের মৃত্যু এক বিরাট রহস্য হয়েই থেকে যায় জনসমাজে। ২০১০ সালে ডেনমার্কের  বিখ্যাত প্রত্নতাত্বিক প্রফেসর জেন্স ভেলেভ, চার্চ ও আদালতে দরখাস্তের মাধ্যমে, আবার ব্রাহের দেহাবশিষ্ট কবর থেকে উদ্ধার করার অনুমতি পান। কিন্তু ফলাফল সেই একই। বিষপ্রয়োগ মিথ্যে প্রমানিত হয়ে রহস্যের অন্ধকারে ডুবে রইল জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের মৃত্যু।

তথ্যসূত্রঃ

1) Life and Times of Tycho Brahe by Niall Kilkenny.

2) A Chronicle of Mathematical People by A. Robert

3) The lord of Uraniborg: A Biography of Tycho Brahe by  Victor E. Thoren.

4) Tycho Brahe : A Picture of Scientific Life and Work in the Sixteenth Century by Dreyer, J. L. E.

আমার শহর দিল্লী- ১

img_20161023_113637

‘হট বঙ্গালি বুড়িয়া!  ক্যা সোচা, বংলা মে গালি দেগি অর কুছ সমঝ না আয়েগা? বংলা হমে ভি আতা হ্যায়……’।

ফেরতা দিয়ে শাড়ি পরা মহিলা, যাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল আধবয়সী লোকটা, তার আঁচল তখন মাটিতে লুটোচ্ছে। সে ছিটকে উঠে পালাতে পালাতে বলে উঠল, ‘উঁহহহহহহ, ভাতার আমার, মিনসের ঢঙ দেখ যেন………’।

বাংলার মাঠ ঘাট ডিঙিয়ে, রাজধানীর মহাজনপথে, বাজারে, হোক না ভদ্রজনে অশ্রাব্য। তবু, আহা, কি শুনলাম, এ যেন ‘আমার প্রানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল রে!’ আঃ, কতদিন পরে।

মিলন মুখোপাধ্যায় দেশ পত্রিকাতে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন –‘মুখ চাই মুখ’। তার মুখ্য চরিত্র, ছবি আঁকিয়ে, প্যারিসের রাস্তায় দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি এঁকে লিখে দিত – ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি , তাই পৃথিবীর রুপ খুঁজিতে যাই না আর…’। আর আমি ভরা দুপুরে বাংলার এ কোন মুখ দেখিলাম!

দাঁড়িয়ে পড়লাম। সত্যি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা শুনলাম, দেখলাম। দুটি প্রায় সমবয়সী নারী পুরুষ, চুলো চুলি হাতাহাতি নয়, শুধু মুখের তুবড়ি সম্বল করে লড়ে গেল !  আর আমি, নিজেকে একমাত্র বাঙালি শ্রোতা ভেবে মজা দেখছি। হটাত দেখি জিন্স-টপ -কলেজ- পড়ুয়া দুই তরুণী আলুথালু মহিলার কথা শুনে, হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ল। সর্বনাশ, এরা বাঙালি না হয়ে পারে না। এবার আমার লজ্জা পাবার পালা। এই বয়সে অন্ততঃ দুটি বাচ্চার মেয়ের সামনে……, তাই পিঠ টান দিতেই হল।

কিছু বই খাতা পেন কিনে ফিরে আসছি। দেখি আধঘরে পুরুষটি কাগজের প্লেট হাতে নিয়ে উবু হয়ে বসে চাউমিন খাচ্ছে। একটু দূর থেকে নারীটি সতৃষ্ণ চোখে তাই গিলছে, হয়তো অভুক্ত পেট! এতক্ষনে বোঝা গেল বিরোধের কারণ। চাউমিনের দোকান থেকে একটি মাত্র প্লেট জুটেছিল খাবার জন্য। সেই নিয়ে কাড়াকাড়ি। পুরুষটি মুখ তুলে আমার দিকে চোখ পড়তে হাসবার চেষ্টা করল। উনি আমার পূর্বপরিচিত। একসময়ে সমাজ তত্ত্বের উপর গবেষণা করতেন। কেউ তার থিসিস চুরি করে জমা দিয়ে ডক্টরেট পেয়ে যায়। তারপর থেকে দেখা দেয় মাথার গোলমাল। বর্তমানে ছাত্র ছাত্রীদের গবেষণার কাজে সাহায্য করে কিছু রোজগার পাতি করেন (যখন তিনি সুস্থ থাকেন)। সদাশয় এক ব্যক্তি তাকে থাকবার একটা জায়গাও দিয়েছেন। ক্ষুরধার বুদ্ধি সম্পন্ন এই ভদ্র মানুষটির সমস্ত চিন্তাজগত জুড়ে শুধু দেশ ও সমাজ। মাঝে মধ্যে মস্তিষ্কে যখন আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তখন তিনি দেশ ও সমাজ নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। কিছুটা অসংলগ্ন হলেও তার কথার সারবত্তা বুঝতে পারা যায়। তাই হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা সসম্ভ্রমে তার কথা শোনে। কখনো দেখি ঝোলা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বিপর্যস্ত শরীর টেনে টেনে চলেছেন, মুখে চিন্তার ছাপ।

এ মানুষটিকে কি বলবেন, উন্মাদ? নাকি উন্মাদ আমরাই, যারা বাঁধাগতের জীবন যাপন করে চলেছি, স্রেফ চলতে হয় তাই! উপরের ওনার নিজহাতে  লেখা পোস্টার বোধহয় কিছু বলতে চাইছে।

পেটো কথা

চায়ের দোকানে হারুন দার সাথে বসে সবে চায়ের কাপটা মুখে তুলেছি, অমনি দুড়ুম করে বোমা ফাটার শব্দ। হারুন দা চায়ের কাপে চুমুক দিতে মুখ নাবিয়ে থমকে গিয়ে, আবার মুখ ডুবাল। ভুরূ কুঁচকে না তাকিয়ে বলল, ‘ভয় পেলি না কী?’

বললাম ,’না তো! কিন্তু কী হচ্ছে বল তো?’

হারুন দা মুখটা তেতো খাবার মত করে বলল ,’ধুস, এগুলো শুধু ধোঁয়া ছাড়ে। আওয়াজে দম নেই, ভেতরটা ফাঁকা। পেটো বানাতাম আমরা। এরা কিছু জানে না কি! আমাদের বাতকম্মোতে এর চাইতে বেশী শব্দ হত’।

 

হারুন দা সত্তরের দশকের উত্তাল রাজনীতি করা লোক। আমাদের মধ্যে যারা ষাট বা সত্তরের দশকে জন্মেছে, তারা জানত বাংলার পেটো শিল্পের কথা। পেটো তখন ছিল বাংলার কুটির শিল্প। একদিকে রাজনীতির দালালরা তাদের ক্ষমতা বাড়াবার প্রচেষ্টায় দাঁত আর নখের প্রয়োগ করছে, আর একদিকে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে অসহায় উদ্বাস্তু, যেখানে ফাঁকা জমি পাচ্ছে, সেখানেই ‘কলোনি’ বানাচ্ছে। কর্মসংস্থান নেই, আছে বুক জুড়ে হতাশা। তাই তরতাজা যুবকেরা বেছে নিল রেলের ওয়াগান  ভাঙা বা কলোনি জবরদখলের কাজ। কলকারখানা বন্ধ হল। বাবা, কাকা বা দাদাদের কাজ গেল। রাজনৈতিক নেতারা কেউ জেলে, আর কেউ ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত। এক একটা সংসারে দশটা বারোটা খালি পেট,  দু তিনটে বিয়ের যুগ্যি মেয়ে। এলাকা দখল করতে হাতিয়ার হল পেটো। বারুদ ভরে, পেটের ভিতর পেরেক, ভাঙা ব্লেড, কাঁচের টুকরো ভরে দিয়ে পাটের সুতো দিয়ে কষে বাঁধলেই পেটো তৈরি।

 

শিয়ালদা স্টেশন থেকে উত্তর আর দক্ষিনে যে রেললাইন, তার দু দিকে দেখতে দেখতে গড়ে উঠল অজস্র উদ্বাস্তু কলোনি। আর ওয়াগান ব্রেকার, ছিনতাই বাজেদের দাপট উত্তক্ত করে তুলল জনজীবন। তখন মেয়েরা স্কুলে যায় শাড়ি পরে, বিকেলে কিশোরেরা ব্রতচারী করে খেলার মাঠে। আর কিছুই পাওয়ার ছিল না, তাই কোথাও কোথাও ‘সব পেয়েছির আসর’ বসত। তখন রাস্তায় টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার সময় একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বললে, শহরতলিতে সেটা খবর হত।

 

পেটো বানাতে প্রয়োজন হত দক্ষ হাতের। বাঁধতে গিয়ে ফেটে গিয়ে কারো কারো হাত বা পা উড়েও যেত। তাদের কথা লোকের মুখে মুখে ফিরে রূপকথার মত হয়ে যেত। বিশেষ উপাধির মত তাদের নাম উচ্চারিত ‘হাত কাটা বাপী’, ল্যাংড়া কার্ত্তিক’ ইত্যাদি বলে। রাস্তা দিয়ে তারা চলত বীরের মত। সসম্ভ্রমে মানুষজন তাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। রবিনহুডের গল্প ওদেরও জানা ছিল। শোলে ফিল্ম তখনো তৈরি হয় নি। তাই মায়েরা ‘শো যা বেটা, নেহি তো গব্বর সিং আ জায়েগা’, না বললেও, সন্ধ্যে আটটা বাজলেই শহরতলির রাস্তাগুলো সুনসান হয়ে যেত। রাস্তা গুলো তখন চলে যেত রবিনহুডদের হাতে। মেয়েটা, বাবা বাড়ী ফিরছে না দেখে, গলির শেষপ্রান্ত পর্যন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ কড়কর করে তুলত। কলেজ পড়ুয়া ছেলেটা সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হলেও বাড়ি না ফিরলে, মা জল স্পর্শ করত না।

 

আমি যে শহরতলিতে মানুষ হয়ে উঠলাম, সেই জায়গাটা রেল স্টেশন থেকে সামান্য দূরেই। স্টেশন পার হয়ে রিক্সা স্ট্যান্ড। তার গা লাগানো কালী মন্দির পেরিয়ে রেলের মাঠ। মাঠ ছাড়ালেই লম্বা রাস্তা। ডান দিকে বাঁক নিতেই ফাঁকা জমি। চারিদেকে গাছ গাছালিতে ঘেরা শান্ত জায়গাটা সাধ্যের মধ্যে পছন্দ হওয়ায় বাবা কিনে ফেলেন। আস্তে আস্তে চারিদিকে একতলা দোতলা বাড়ি উঠতে থাকে ক্রমশঃ। স্টেশন থেকে যাতায়াতের পথটা এক সময় এই পেটো বাজেদের এলাকা হয়ে ওঠে এবং আস্তে আস্তে গা সওয়া হয়ে যায়। পথে আসতে যেতে, কোনও রবীনহুডের দেখা হলে, কখনও কখনও তারা সৌজন্য বিনিময় করত, ‘ভাল আছ? বাবা ভাল আছেন তো?’

ঘাড় নেড়ে জবাব দিয়ে চলে যেতে যেতে নিজেকে ধন্য মনে হত। এই রবীনহুডেরা তাদের জমে ওঠা টাকা দিয়ে পুন্য কিনতে, কারো মেয়ের বিয়ের জোগাড় করে দিত, আবার দোচালা বানিয়ে মাথা গোঁজার জায়গাও করে দিত। কালী পুজো করত মদ খেয়ে ফুর্তি করার জন্য। চাঁদা আদায় করতে কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে বাড়ি বাড়ি যেত। মুখে তাদের রুমাল গোঁজার প্রয়োজন হত না, কারণ এলাকার লোকেরা সবাই তাদের চিনত।

 

এমনই একজন নায়ক ছিল যার নাম ছিল গোলাপ। তার চেহারা গোলাপকেও ম্লান করে দিতে পারত। হটাতই একদিন জানা গেল গোলাপ আমাদের পাড়ার এক সুন্দরীর প্রেমে পড়েছে। প্রেমিকার পাঁচিল টপকে প্রেম চলছিল ভালই। বাধ সাধল প্রেমিকার ভাই ন্যাপাদা। একদিন সকালবেলা বাজার যাবার সময় চায়ের দোকানে গোলাপকে পেয়ে কলার চেপে ধরল। ন্যাপা দাকে সাহস যুগিয়েছিল তার রাজনীতি করা বন্ধুরা। আসল সময়ে তাদের আর খুঁজে পাওয়া গেল না। একদিন সন্ধ্যে বেলা, আমরা কিশোরেরা যখন সবে ফুটবল মাঠ ছেড়েছি, শোনা গেল ন্যাপাদার পেটে গোলাপ আট ইঞ্চি চাকু ঢুকিয়ে দিয়েছে। ন্যাপাদা পেট চেপে রিক্সায় বসে সোজা হাসপাতালে। চাকু চালাবার পর যাতে সামনে আসতে কেউ সাহস না করে, তাই পরের পর পেটো চার্জ করে যেতে থাকে গোলাপের দলবল। সে রাতেই প্রেমিকাকে বগলদাবা করে গোলাপ পগার পার। পেটো বাহিনীর সাথে থানার পুলিশদের যথেষ্ট যোগসাজশ থাকায় কোন কেসই আদালতে ওঠে নি। ন্যাপাদাও বীরের মত হাসপাতাল থেকে বেঁচে ছাড়া পায়।

 

রেল মাঠের পাশ দিয়ে ফিরছি। কাঁধে তখন কলেজের ঝোলা ব্যাগ। অন্যমনস্ক এক বিকেল। হটাত একটা রোগা ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল, ‘দাদা একটু দাঁড়িয়ে যান’।

জিজ্ঞেস করলাম ‘কেন?’

– ‘ বলছি শুনুন না। একটু পরে যাবেন’, বলে হাত ধরে টেনে রেলের একটা কোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর নিচু হয়ে, মাটিতে পড়ে থাকা একটা ব্যাগ তুলে হা রে রে রে করে ছুটে গেল মাঠের দিকে। দুম করে একটা পেটো পড়ল মাঠের মাঝ বরাবর। সেই রোগা ছেলেটার কি প্রবল দাপট! সেও বাউন্ডারি থেকে ফিল্ডার যেভাবে বল ছোঁড়ে উইকেট লক্ষ করে, সেভাবে ছুঁড়তে লাগল একটার পর একটা। কোনটাই কারো গায়ে লাগল না। মাঠের মাঝে ঘাস পুড়ে গেল, আর কিছু ক্ষত সৃষ্টি হল। এ যেন ভারত – পাকিস্তান সীমান্ত প্রহরার রুটিন গোলাবাজি! কিছুক্ষণ পর সব শান্ত। যে যার নিজের এলাকায় ফিরে গেল। স্টেশন থেকে সওয়ারি নিয়ে প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ তুলে রিক্সার দল ছুটতে লাগল। দোকানের ঝাঁপ গুলো খুলতে লাগল।

 

 

হারুন দা চা খাওয়া শেষ করে পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল, ‘শালারা আমার পিঠে এমন ঝেড়েছিল, সে ব্যাথা এত বছর পরেও চড়চড় করে ওঠে’।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে পিছন ফিরে শার্টের কোনাটা তুলে পিঠ দেখাল। চমকে উঠলাম, পিঠের উপর বোমা ফেটে যাবার দগদগে পুরনো ক্ষত। শার্ট নাবিয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে চলে গেল হারুন দা। আর আমি তার অপস্রিয়মাণ শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

 

আনাড়ি পাঠক এবং দিল্লী বইমেলা

সরকারী চাকরি করতে গিয়ে কলমের ধার গেছে ভোঁতা হয়ে। তাই লেখকের থেকে পাঠক হওয়াটাই বেশী নিরাপদ মনে হওয়ায়, গত বছর দিল্লী বইমেলায় দুপুর বেলা যখন পৌঁছলাম, তখন বই ক্রেতার চাইতে, বই বিক্রেতার সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। উদ্যোক্তাদের মধ্যে যারা পরিচিত ছিলেন, তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করে যে গুটিকতক স্টল ছিল, সেদিকে এগোলাম। লেখক বন্ধুর সদ্য প্রকাশিত বই কিনব। প্রকাশকের স্টলে হাজির হলাম। স্টল সামলাচ্ছিলেন যে বুদ্ধিদীপ্ত যুবকটি, তিনি তখন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যাবস্থাপনায় অতি ব্যস্ত। ক্রেতা দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন। অভ্যর্থনাও করলেন। জানালাম, আমি আমার বন্ধুর সদ্যপ্রকাশিত বই কিনতে চাই। বইটি বার করেই বললেন, ‘আমারও একটি বই প্রকাশিত হয়েছে’। উলটে পালটে দেখছি। আমার হাত থেকে বইটি কেড়ে নিয়ে প্রথম পাতায় খসখস করে আমার নাম লিখে, নিচে নিজের নাম সই করে দিলেন। ভাবলাম, আমাকে উপহার দিলেন। এমনি তো হবার কথা! শুনেছি বড় বড় সাহিত্যিকেরা নাকি পাঠকের প্রতি প্রসন্ন হলে, এমনটাই করে থাকেন। তরুণ লেখকটি বলে উঠলেন, ‘নিরানব্বই টাকা’। বেজার মুখে একশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম। এক টাকা খুচরো ফেরত পেলাম না। দিল্লীতে একটাকা, দু টাকাকে তাচ্ছিল্ল করা হয় জানা আছে। তাই আর দাঁড়ালাম না। মনে পড়ল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, রয়্যালটির টাকা চাইতে নাকি লজ্জা পেতেন।

দুটি বই হাতে নিয়ে এগোলাম। দেখি বিভূতিভূষণ মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন আর স্টলের মালিক হাতে মোবাইল নিয়ে খেলছেন। বললাম বিভূতিভূষণ রচনাবলী কিনব। মাটি থেকে বিভূতিভূষণকে তুলে এনে সেই শীর্ণকায়া ছেলেটি দুটি খন্ড ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেল  না। বলে, ‘বিক্রি হয়ে গেছে’। রচনাবলীর খন্ড গুলোও আলাদা আলাদা করে বিক্রি হয় সেটা জানা ছিল না। দু খন্ডেই পেট ভরিয়ে ফিরতে হল। ফেরার আগে আমার পুত্রের জন্য বাঁধাই ‘নন্টে ফন্টে’ আর ‘ফেলুদা সমগ্র’ কিনে নিলাম।

পরের স্টলে গিয়ে দেখি বেজায় ভিড়। সেটি একটি লিটল ম্যাগ প্রকাশন। তাদের আবার ফেসবুক গ্রুপও আছে। সাজুগুজু করা সব বয়সী মহিলা পুরুষ। ওরে বাবা, এরা সবাই একই প্রকাশনের লোক! সর্বনাশ, সুদূর কোলকাতা থেকে দল বেঁধে বই বেচতে এসেছে! আমাকে দেখে সবাই হইহই করে উঠল। আমি প্রমাদ গুনলাম। এদের লেখার সাথে আমি পরিচিত। তার মান সম্পর্কে কি আর বলি। সে যাক গে, এসে যখন পড়েছি, নিস্তার নেই। মুখে হাসি ফুটিয়ে স্টলে ঢুকলাম। সবচাইতে সুন্দরীটি আবার আমার গা ঘেঁসে মুখ তুলে আমাকে দেখে যে! ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই, তাই স্ব-পত্নী স্বরণম। বলে ‘আমার বই, একটু দেখুন’। কি ছেড়ে কি দেখি! পাশ থেকে একজন দশাসই মধ্যবয়সিনী বায়স কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বইটা নিলে এর সাথে আর একটা বই পাচ্ছেন, ফ্রী’। পাতা দু একটা উল্টাচ্ছি তখন। ভাবছি বেঁচে ফিরলে হয় আজ! পকেটের বটুয়াটাও একটু নেড়ে দেখলাম ঠিক আছে কি না। ভিড়ে পকেটমার না হয়ে যায়। মুখ তুলে দেখি আরো দু তিন জন। কি করি, কোথায় থাকি, ইত্যাদি ইত্যাদি। বুঝলাম, আজ এত বেলাতে আমিই প্রথম খদ্দের। চাপদাড়ি তরুণ বলে উঠল, ‘এই বইটা আপনার ভাল লাগবে নিশ্চই, এটা আমার লেখা, সাম্প্রতিক যে সব ঘটনা……’। বিপদ কালে বুদ্ধি নাশ যে হয় নি, বুঝলাম সচ্ছন্দে আমার হাতটা যখন পকেট থেকে মোবাইলটা টেনে বার করল। অন্তরাত্মা বলল, ‘চল ধন্নো, আজ তেরা ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়’।

‘একটা ইম্পরট্যান্ট কল এসেছে’, বলে হনহনিয়ে স্টলের বাইরে পা। পিছনে কয়েক জোড়া চোখ, আমার পিঠকে তখন ফালাফালা করছে। সে করুক গে যাক। খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বাইরের চায়ের দোকানে বসে চায়ের অর্ডার করলাম। পাশে একটি স্কুলের বাচ্চা বসে।তার হাত খালি দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বই কেন নি?’ বিরক্তি ভরা জবাব এল,’না’। তার রোদ চশমা পরা মা উত্তর দিলেন, ‘দেখুন না, একটাও ইংরাজি বই রাখে নি এখানে। আমার ছেলে আবার বাংলাটা একেবারে শেখে নি’। বাংলা না শেখানো বাবা মাকে পাশে নিয়ে ভাবলাম, ‘দাও ফিরে সে অরন্য, থুড়ি, দাও ফিরে সেই কলকাতা’, যেখানে একদা প্রেমিকার হাত ধরে এ স্টল ও স্টল করেছি। পকেটে পয়সা বাড়ন্ত ছিল, তাই বইয়ের বিজ্ঞাপনের কাগজ সম্বল করে ফিরেছি। তখন প্রগতি পাবলিশার্স বেঁচে, তাই দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়েছি (অনুবাদ গুলো সব ক্ষেত্রে ভাল হত না)।

এবার একটা মাটির ঘট কিনব, আর তাতে রোজ দু এক টাকা ফেলব। আগামী বছর কোলকাতা বইমেলায় যাওয়ার খরচাটা নিশ্চই উঠে যাবে, কি বলেন?

ভুল সবই ভুল………

মানুষ ভুলে যায় কেন, এ নিয়ে মনস্তাত্বিকদের চিন্তার শেষ নেই। আর সত্যিই তো, ঠিক সময়ে মনে পরে না অনেক কিছুই। তখন রাগ হয় কেন মনে পরছে না, বলে। আবার অনেক মানুষ আছে যারা ভুলের সমুদ্রে তলিয়ে থাকতেই ভালবাসে। ওইটেই তার বিলাসিতা হয়ে দাঁড়ায়।

তারাপদ রায়, যাকে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আদর করে ডাকতেন ‘টর্পেডো’ বলে, তিনি এমনই একটি হাসির টর্পেডো ছেড়েছিলেন। এক ভদ্রলোক কিছুই মনে রাখতে পারতেন না। এ নিয়ে তার স্ত্রীর বিড়ম্বনার সীমা ছিল না। একদিন সকালে ভদ্রলোককে ঘুমের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। প্রতিবেশীরা মৃত্যুর কারন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে, স্ত্রী বললেন, ‘ যা ভুলো মন ছিল, বোধহয় নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গিয়েছিল!’

মানুষ যদি ভুলে না যেত তাহলে কী হত? মস্তিষ্কে চাপ পড়ে যা তা একটা ব্যাপার হত। আরও কি কি ঘটতে পারত ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এটা তো ঠিক যে কিছু সংসারী ব্যাপার স্যাপার, মানে দাম্পত্য কলহের শুভ মুহূর্তে, মেয়েরা সব মনে রেখে, ঠিক সময়ে ঠিক উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। পুরনো কোন ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবৃতি দিয়ে পুরুষটিকে কাবু করে ফেলে। ভাগ্যিস সেই সময় ছেলেদের কিছুই মনে পড়ে না। তাই রক্ষে। নইলে দাম্পত্য কলহ আর বিশ্ব যুদ্ধের মধ্যে কোন তফাত থাকত না।

একটা গল্প পড়েছিলাম, সুত্র মনে নেই। এক অশীতিপর বৃদ্ধ, বাড়িতে অথিতির সামনেই বার বার তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে ‘ডার্লিং আমার মাফলারটা দাও তো’, বা ‘ডার্লিং আমার ওষুধের শিশিটা দাও না প্লিস’, ইত্যাদি বলছিলেন। অতিথি বিস্মিত হয়ে বৃদ্ধকে বললেন, ‘বাঃ আপনাদের প্রেম তো দেখার মত। আপনি এই বয়সেও ওনাকে ‘ডার্লিং’ ছাড়া সম্বোধন করেন না।বৃদ্ধ সামান্য হেসে বললেন, ‘আজ প্রায় এক দশক হল আমি আমার স্ত্রীর নাম ভুলে গেছি। সে কথা তো আর ওকে বলা যায় না, তাই ডার্লিং বলে ডাকলে বিপদের সম্ভাবনা কম’।

এ তো গেল শোনা কথা। এবার একটা পরিচিত মানুষের ভুলে যাওয়ার সত্যি ঘটনা বলি। ভদ্রলোক সরকারী চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন সংখ্যাতাত্ত্বিক। পড়াশুনোতে ভাল তো ছিলেনই, কর্ম জীবনে বেশ সুখ্যাতি ছিল। কিন্তু ওই এক দোষ, সব ভুলে যেতেন। আসলে চিন্তাবিদদের এরকমই হয়। তিনি একা থাকতেন একটি বাসা ভাড়া করে। গরমের ছুটিতে বউ এলেন ছেলে পিলে নিয়ে সময় কাটাতে। ভদ্রলোক এক রবিবার সকালে ঠিক করলেন সবাইকে নিয়ে চিড়িয়াখানা যেতে হবে। কর্তা তার স্ত্রীকে বললেন, ‘বাচ্চাদের নিয়ে বাস স্টপে এস, আমি এগোই’। তিনি একটি সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বাস স্টপে এসে আপনমনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঘণ্টা খানেক কেটে গেল, বউয়ের দেখা নেই। কর্তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। তিনি আরও একটি সিগারেট ধরিয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। বাড়িতে এসে দেখলেন দরজায় তালা ঝুলছে। বেজায় রেগে গিয়ে, দূর ছাই বলে তিনি ঠিক করলেন চিড়িয়াখানায় যাওয়ার কোন মানেই হয় না। তালা খুলে দেখেন, বউ বাচ্চারা হতদ্যম হয়ে ঘরের মধ্যেই বসে। মানে কর্তাটি বউকে বাস স্টপে আসতে বলে, সব ভুলে গিয়ে তালা ঝুলিয়ে বাড়ির থেকে বেরিয়ে পরেছিলেন। তার পর নিশ্চই ভদ্রমহিলা বাচ্চাদের নিয়ে রেলে চেপে পড়েছিলেন, ছুটি ফুরানোর আগেই।

স্বর্গ মর্ত্য ডিজিটাল ডিভাইড

যে ডিজিটাল ডিভাইড সাম্প্রতিক কালে মনুষ্যকুলকে কুক্ষিগত করেছে, তার ঢেউ ধাক্কা দিয়ে নড়িয়ে দিয়েছে স্বর্গের ভিত। সেখানে টপ, মিডল আর লোয়ার ম্যানেজমেন্টের মধ্যে নেই কোন তাল মিল। মর্ত্যবাসীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে স্বর্গের দেবতাকুল।

ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের হাই লেভেল মিটিঙে ব্রহ্মা মহেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আজকাল ডাকলে পাওয়া যায় না, থাকো কোথায়?”

মহেশ্বর তার ঢুলু ঢুলু চোখ তুলে বললেন, “মোবাইল এর ব্যাবস্থা করতে পারেন না! দেখুন তো মনুষ্যকুল সারাক্ষণ এই যন্ত্রে লেগে আছে তো আছেই! থাকত যদি মোবাইল, একটা মিস কল দিলেই দৌড়ে আসতাম। আমরা সেই পুরনো ওয়ারলেস সিস্টেমে পড়ে আছি…”

বিষ্ণু পদ্মাসনে বসেই বলে উঠলেন, ‘সেবকদের পুজোও যথাসময় দেবতাদের কাছে পৌঁছচ্ছে না। কানেকশন কেটে যাচ্ছে। পণ্ডিতদের টিকির এন্টেনা সিগনাল পাঠাতে অক্ষম হয়ে প্রছে।কিছু একটা না করতে পারলে বিপদ আসন্ন প্রভু’।

তৎক্ষণাৎ তলব গেল বিশ্বকর্মার কাছে। কালি ঝুলি মাখা হাত নোংরা ধুতিতে মুছতে মুছতে হাজির বিশ্বকর্মা। ব্রহ্মা রেগে আগুন, “কী কর সারাদিন? মানুষ্য জাতির হাতে হাতে, কি বুড়ো কি ছুড়ো, মোবাইল দেখেছ? তোমার কারখানাতে এর একটা ক্লোনও বানাতে পার না? ঠিক সময়ে যোগাযোগ না রাখতে পেরে স্বর্গের এডমিনিস্ট্রেশন যে যেতে বসেছে সে খবর রাখ?”

বেজার মুখে অপ্রস্তুত বিশ্বকর্মা “যথা আজ্ঞা” বলে চলে গেলে বিষ্ণু প্রস্তাব রাখলেন, “জগত পিতা, শুধু মোবাইল বানানোই যথেষ্ট নয়। ইন্টারনেট বলে একটা ব্যাপার আছে। সেটা না থাকলে কিছুই নেই। মানব জীবনে এখন এটাই আছে, তাতে ফেসবুক বলে আবার আর একটা ব্যাপার, সারাদিন তা নিয়ে লোকে এত মেতে থাকে, যে দু দণ্ড কথা বলার সময় নেই কারো। কথা যা হয়, তা ওই ফেসবুক বা মোবাইলে হোয়াটস এপে…”

এতটা শুনেই নাকি ব্রহ্মার চারটি মাথাই বাঁই বাঁই করে ঘুরতে থাকে। বয়স তো কম হল না! এত কিছু মাথায় নেওয়া বেশ মুশকিল, তা বুঝতে পারলেও, প্রকাশ করে দিলে স্বর্গের উপর আধিপত্ত কমে যাওয়ার ভয় আছে না! ওনার আবার বয়সের ভারে শুধু ডানমুণ্ডুটিই আজাকাল কাজ করে। বাকি তিনটি অনেকদিন যাবত শাট ডাউন।  কাজেই ওনার আচরণ অনেকটা দক্ষিণ পন্থি। বললেন, “এটা বিশ্বকর্মার একার পক্ষে করে ওঠা অসম্ভব, সবাই মিলে কাজ করতে হবে। মানুষ পারলে আমরাই বা কেন পেরে উঠব না!” দিলেন একটা সরকারী সারকুলার জারী করে। উচ্চ, মধ্যম আর নিম্নস্তরীয় দেব দেবীদের সাধারন সভার নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হল।


দেব দেবীদের সাধারণ সভায় বেজায় শোরগোল দেখে ব্রহ্মা তার ভেটো প্রয়োগ করে দিলেন। সভাগার শান্ত হতে বিষয় সংক্ষেপে জানিয়ে কলাকুশলী কার্তিককে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি তো আমাদের সবার মধ্যে বয়সে তরুণ, তুমি কি পারবে স্বর্গকে ডিজিটাল করে তুলতে?”

কার্ত্তিক হোম ওয়ার্ক না করে আসা ছাত্রের মত মায়ের আড়ালে নিজেকে লুকোতে লুকোতে বলে উঠল, “আমি মানে, মানুষদের মত…   আসলে ওটা আবার আমার সিলেবাসে ছিল না তো…!

ব্রহ্মা বিরক্ত হয়ে  পবন পুত্রকে বললেন, ‘গন্ধমাদনের মত পারনা মানুষের কাছ থেকে ওই সব কি যেন বলে, মোবাইল, কম্পিউটার এসব উঠিয়ে আনতে?’

পবনপুত্র বললেন, ‘ওটা শিখিনি প্রভু।এ যুগে ওটাকে বলে চৌর্যবৃত্তি। ইন্দ্রদেবকে বলে দেখুন না, উনি তো সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর!’

ইন্দ্রদেব তখন সবে সভায় প্রবেশ করছেন। তার বিলম্বে ব্রহ্মা রেগে আগুন। বোর্ড মিটিঙে সি ই ও যেমন ভাবে সদস্যদের জরীপ করে, তেমন ভাবে চেয়ে রইলেন। বরুণ চিমটি কাটতে ছাড়লেন না। চাপা জড়ানো গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজকাল কি সকাল সকালই অপ্সরাদের নাচের ব্যবস্থা করেছ না কি হে!’

ইন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘না হে। রম্ভার দুটো হাঁটুতেই বেজায় ব্যথা। ধন্যন্ত্ররী বলেছে হাঁটু বদলাতে হবে। নকল হাঁটু নিয়ে আর কি নাচতে পারবে? উর্বশীও আজকাল খুব ঝামেলা করছে। নাচতেই চায় না, বলে পারিশ্রমিক বাড়াও। এর চাইতে আই পি এল এ চিয়ার গার্লের কাজে নাকি পারিশ্রমিক অনেক, আর খাটুনিও কম। তাই আমার দরবারে নাচানাচি এখন একেবারে বন্ধ’।

‘কারা কথা কয়?’ ব্রহ্মা চেঁচিয়ে উঠলেন। ইন্দ্র, মহেশ্বর  নীরব হলেন’। ‘ডিজিটাল স্বর্গ’ নিয়ে মীমাংসা অধরাই রয়ে গেল। সভা পণ্ড হতে যাচ্ছে দেখে, দেবী দুর্গা তার একটি হাত উঠিয়ে কিছু বলতে গেলেন, কাজ হল না। পাশ থেকে লক্ষ্মীর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে দুর্গা দশটি হাত তুলতে ব্রহ্মার নজর পড়তে বললেন, ‘প্রভু, আমার মর্তের ট্যুর প্রোগ্রামে আপনার সই হয় নি’।

ব্রহ্মা বললেন, ‘আজকের সভা তো স্বর্গকে ডিজিটাল করবার জন্য  ডাকা হয়েছে। ট্যুর আসছে কোথা থেকে?’

‘ পুজো আসন্ন প্রভু’।

‘সুত্রের খবর অনুযায়ী তোমার ভক্তরা পুজোতে যত না মনযোগী, তার চাইতে বেশি সেলফিতে। পুরহিতেরাও নাকি পুজো করতে করতে হয়াটস এপ করে!’

‘তা হয়ত হবে প্রভু। তবু সই টা করে দিলে একবার ঘুরে আসতাম। অভ্যেস হয়ে গেছে যে বছরে একবার যাবার’ দুর্গা বলেন আক্ষেপ করে।

‘তোমার ছেলে মেয়েরাও হয়ে গেছে সেকেলে। কিছুই পারছে না শিখতে। প্রতি বছরই যায়, কি শেখে? শুনলে তো, তোমার ছেলে কার্ত্তিক কত পিছনে পড়ে আছে! মানুষ ঠেকে শিখছে, আর দেবতারা?’ ব্রহ্মা রেগে ওঠেন।

বীরেশ্বরের জলদগম্ভীর স্বর বেজে উঠল। ব্রহ্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘প্রভু, দেবতাদের দ্বারা যে কম্ম হচ্ছে না, তা স্বর্গবাসী মানুষদের দিয়ে করানো হোক। বেশ কিছু ট্যালেন্টেড মানুষ স্বর্গোদ্যানে খেলে বেড়াচ্ছে আর বিনে পয়সায় খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে। বেঁচে থাকতে যারা বুদ্ধিজীবী ছিল, বুদ্ধির উপর চর্বি জমিয়ে তারা দিব্যি আছে’।

ডাক পড়ল চিত্রগুপ্তের। যাও খাতা আন, রেকর্ড দেখে বল কারা স্বর্গকে ডিজিটাল করতে পারবে। চিত্রগুপ্ত হাঁফাতে হাঁফাতে সভায় প্রবেশ করল, সাথে দশজন খাতা বাহক। ব্রহ্মা পুত্রের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘হে বৎস, খাতা দেখে বল, কোন কোন স্বর্গবাসী মনুষ্য স্বর্গকে ডিজিটাল করবার ক্ষমতা রাখে?’

চিত্রগুপ্তের ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল। বুঝে নিয়ে উত্তর দিল, ‘হে প্রভু, সমস্ত খাতা দেখে উত্তর দিতে অনেক সময় লাগবে’।

ইন্দ্র ও বরুণ জোরে জোরে হেসে ওঠায় সভা কাঁপতে থাকল। দেবরাজ বলে উঠলেন,’ এখানে রেকর্ড কিপিং খুব খারাপ প্রভু। মানুষ বাড়ছে সংখ্যায়, মরছেও। এখন প্রয়োজন ই রেকর্ড। এ সব চিত্রের কর্ম নয়।‘

ব্রহ্মা হতাশ হন, ‘তা হলে কি মানুষ আমাদের উপর আধিপত্য ফলাবে অদূর ভবিষ্যতে? দেবতাদের সব ক্ষমতা যাবে হারিয়ে!’  ব্রহ্মার তিনটি মাথাই এবার ঝিমঝিম করতে থাকে। শক পেয়ে বাকি দুটো অকেজো মাথাতেও প্রাণ ফিরে আসে। মাথা তিনটি ঘেমে ওঠায়, তিনটি মুকুট এক এক করে খুলে রাখেন টেবিলে। তাঁর মাথার উপর ত্রিকালের ঘড়ি বেজে ওঠে ঢং ঢং শব্দে।

অথ নস্যি কথা

সদর দরজা খুলতেই যাকে দেখা গেল, তার মাথায় সাদা পাকা চুল, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। চিনতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন,”আসবো?”। বললাম, “আসুন, কিন্তু চিনলাম না আপনাকে”
একপা ঘরের ভিতর এগিয়ে দিয়ে বললেন,”আমি তো চিনি আপনাকে!’
অগত্যা সরে জায়গা করে দিতে দিতে লক্ষ্য করলাম, ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আর তর্জনীর মাঝে ধরা আছে এক টিপ নস্যি। সজোরে নাকের ডান ছিদ্রে প্রবেশ করে নাক টানলেন। জুতো খুলতে খুলতে নস্যির ডিবেটা চালান করে দিলেন পকেটে।নস্যির গুঁড়ো ছড়িয়ে পড়ল, নাক সুরসুর করে উঠল।
অনেকদিন পর কাউকে নস্যির নেশা করতে দেখলাম। কয়েক দশক এই গুঁড়ো তামাকের নেশা কাউকে করতে দেখি নি। নস্যির নেশা কি বিলুপ্তির পথে? যে কোন নেশাই অবশ্য বিলুপ্ত হলেই মানুষের মঙ্গল!

স্কুল জীবনে একবার অঙ্কে কম নম্বর পাওয়ায় আমার জন্য একজন মাস্টারমশাই রাখা হল। তিনি পড়াতে আসতেন প্রায় মাঝরাতে, মানে আমার মত তখনকার এক বাচ্চার পক্ষে তো বটেই! তা মাস্টারমশাই সারাদিনের ছাত্রভাঙা খাটুনির পর নিজেকে জাগিয়ে রাখতেই বোধহয়, ঘনঘন নস্যি টানতেন। সেই থেকেই নস্যির উপর বিরক্তি জন্মায়। একে অঙ্ক, তায় খিদের পেট, নস্যির ঝাঁঝালো গন্ধ! নস্যি যারা নেয় তারা ‘ন’ কে বলেন ‘ল’, কারন সর্বক্ষণের সর্দিতে বন্ধ নাকে এই সুরই বেরনোর কথা। মানে ‘নস্যি’ কে বলেন ‘লস্যি’। কিন্তু কোথায় নস্যি আর কোথায় গরমের দিনের লস্যি!সে যাই হোক, আমাকে ঢুলুঢুলু চোখে ‘ভগ্লাংস’এর অঙ্ক করতে হত। একদিন অঙ্ক খাতার পাতায় বেশ খানিকটা নস্যি পরে যায়। মাস্টারমশাই সেদিনের মত পাততাড়ি গুটাতেই খাতায় পড়ে থাকা নস্যি দুই আঙুলে তুলে দিলাম নাকের ভিতরে এক টান। আর যায় কোথা! হ্যাঁচ্চো, হাঁচ্চো, …..চোখ লাল। সবাই ভাবল ঠাণ্ডা লাগল বুঝি। বেজায় হাসি পেল। গান টান ছোটবেলা থেকেই একটু আধটু শুনতাম। মনে পড়ে গেল, ‘হ্যাঁচ্চো, হাঁচ্চো ওওওওওওও, ভয় কি দেখাচ্ছ, হ্যাঁচ্চো’। হাঁচি পেলেও তো সেই রবীন্দ্রনাথ ভরসা!

“সিং নেই তবু নাম তার সিংহ ……” গেয়ে গেলেন কিশোর কুমার। “নাও তার পর একটিপ নস্যি, তার পর খাও এক মগ লস্যি……”

সুকুমার রায় লিখে গেলেন-

“সিংহাসনে বস্‌ল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা,

ছট্ফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর থেকেই
বললে রাজা, “মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?”
মন্ত্রী বলে, “এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!”
রাজা বলেন, “মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,”
বদ্যি বলে, “আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।”
রাজা হাঁকেন , “বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।”
পাত্র বলে, “নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?”

গন্ধ বিচারে পাত্তা না পেলেও এক সময় এ ছিল বড়লোকের নেশা। সপ্তদশ শতকে জন্ম। সর্বপ্রথম সম্ভবতঃ ফ্রান্সে এর উদ্ভব। তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ, আমেরিকাতেও। বড়লোকের নেশা বলে ট্যাক্স বসাতে শুরু করলেন ইংল্যান্ডের অধীশ্বরেরা। নস্যির কত রকমফের, কত প্রস্তুতি পদ্ধতি! নানা বর্ণে, নানা গন্ধে নব রুপে এল। ব্যাবসায়ীদের পকেট ভরল, রাজকোষ উপচে পড়ল। বিরক্তির উদ্রেকও কম করল না ভদ্রসমাজে। ভাবা যায়! যেখানে সেখানে এক টিপ নস্যি নিচ্ছে লোকে, কাপড় নোংরা হচ্ছে, নাক ঝাড়ছে। কাজেই উচ্চবিত্ত সমাজে ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাল। সাধারনের নেশায় পরিণত হল। রাশিয়তে জার রেগে গিয়ে ডিক্রি জারি করল, নস্যি নিলে নাক কেটে দেওয়া হবে। কি ভয়ানক! নাকের বদলে নিশ্চই কর্তিত নাকের মালিককে নরুন দেওয়া হত না।

আমার বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় ভদ্রলোক নাক ঝাড়লেন, ‘প্যাঁ ……।” শব্দ করে।
বললাম, “আবার আসবেল”।
বললেন, “লিশ্চই”।